ব্লগ : স্বগতোক্তি/১৬ । খেলা শেষ, ঝড় আসছে


খেলা শেষ, ঝড় আসছে 

তড়িৎ রায়চৌধুরী 


আমি যখন লিখতে বসেছি তখনি আকাশ গোমড়াথোরিয়াম। আপনার পড়ার সময় নিশ্চয় ‘খেলা’ হয়ে গেছে ‘ইয়াস’ ওরফে ‘যশ’-এর! অথবা, জানলার বাইরে চোখ রেখে বলছেন— খেলা শেষ, ঝড় আসছে!

ওমানের দেওয়া এই পার্সি নামের কথায় মনে পড়ল ঘূর্নিঝড়ের নামকরণ বৃত্তান্ত। ইতিহাসটি ভারি মজার। একসময় বিজ্ঞানীরা ঝড়কে ডাকতেন ভৌগোলিক জন্মস্থান দিয়ে; মানে ৭ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ ও ৭২ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ-এর ঝড়...; ফলে সাধারণ মানুষ ডাকনাম দিত স্থানীয় মর্জিতে। সন্ত, সাল, ক্ষতিগ্রস্ত স্থান-এর নাম যোগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অব্দি এই রকম চলে। ক্রমে পশ্চিমা আবহবিদরা হয়তো দুষ্টুমি করেই মেয়েদের নামে ঝড়ের নাম রাখতে থাকলেন; রিটা, ক্যাটরিনা, স্যান্ডি। কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিবাদের ঝড়ে বদলে গেল রীতি। তবে তা মূলত অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকার গল্প। এ অঞ্চলে “১৮৬৪ ক্যালকাটা সাইক্লোন” আর “১৯৭০ ভোলা সাইক্লোন”-ই চলতে থাকে।

আসলে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি আর ক্রান্তীয় উষ্ণতার জন্য সমগ্র উষ্ণমন্ডলীয় সাগরাঞ্চলেই এক মারাত্মক বায়ুপ্রবাহ জনিত দুর্যোগ দেখা যায়। প্রতি বছর কম বেশি ৮০টা ঘূর্নিঝড় বা ঘূর্ণাবাত। আটলান্টিকে মায়া সভ্যতার ঝড়ের দেবতার (হুয়াকান) নামানুসারে সে হারিকেন, প্রশান্ত মহাসাগরে চিনের বাতাসের(টাইফেং) ইচ্ছায় সে টাইফুন আর ভারত মহাসাগরে বৃত্ত বা সাপের কুন্ডলী বোধক গ্রীক শব্দের(কাইক্লোস) ধারায় সে সাইক্লোন। স্পষ্টত এ অঞ্চলের উপর এক জ্ঞানগত আধিপত্য পশ্চিমের। তাদের আবহবিদরাই নানা নাম দিতেন। ১৯৯৭ সালে শোনা গেল বিদ্রোহের সুর। স্থানীয় ঝড়ের নাম স্থানীয়ই হবে। “ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অরগানাইজেশন” ও “ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিক”-এর সভা বসল। স্থানীয় স্তরে ২০০০ সালে বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্থান, শ্রীলংকা এবং তাইল্যান্ড ৮টি দেশের বিশেষজ্ঞরা নানা নিয়ম মেনে ঝড়ের নাম, রীতি, গতি, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনায় বসলেন। আমাদের ১৮ মাসে বছর। তায় গণতান্ত্রিক ভাবে সকলের সমান অধিকার মেনে চলা। প্রথম নাম হল ২০০৪ সালে ‘অনিল’। প্রথম ৬৪টা নাম ফুরোলে ২০১৮ তে দ্বিতীয় দফার সময় আরো ৫টি দেশকে সদস্য করা হয়। বলা বাহুল্য, শুধু নামকরণ নয় কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ঝড়ের নাড়ী-নক্ষত্র অনুধাবন ও উপযুক্ত সতর্কীকরণ-ও তাদের কাজ।



সাইক্লোনের নাড়ী মানে নাভি অর্থাৎ কেন্দ্রকে বলে চোখ। আকৃতি গত সাদৃশ্যের জন্যই হয়তো এই নাম। এই আপাত শান্ত চোখের বৃত্তীয় পরিসীমার বাইরের অংশটিই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক, কখনও প্রায় আণবিক বোমার সামিল। এই অঞ্চলে এরা সাধারণত আন্দামান নিকটবর্তী অংশে উদ্ভূত হয়ে উদ্ধৃতি চিহ্নের আকারে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে আরবসাগর বা বঙ্গোপসাগর ধরে। অনেকগুলো সমুদ্রেই হারিয়ে যায়, যারা যায় না তারা হারিয়ে দেয় আমাদের। মনে রাখতে হবে সাইক্লোন আছড়ে পড়ার সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঝড়ের গতির মতোই বিপদজনক জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা। জোয়ারের সময় ঝড় মাটি ছুঁলে যে বিপদ অনেকটাই বেড়ে যায়। নদী বাঁধ চৌচির করে ঢোকে লোকালয়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘আয়লা’ আমাদের বিধ্বস্ত করেছে সবচেয়ে বেশি। কারণ প্রস্তুতিহীনতা। জীবন ও জীবিকার দিক থেকে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের মানুষ। তুলনায় ‘আমফানের’ সময় জনগণ নিজস্ব অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়ে প্রতিরোধে প্রস্তুত থাকায় সম্পদ হানি হলেও প্রাণহানি হয়েছে অনেক কম। বরং আমফানে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে কলকাতাবাসী। একে লকডাউন পরিস্থিতি তায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থাহীন জীবন ছন্দ। বিদ্যুৎশক্তি যে আধুনিক শহরে সৌরশক্তির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বোঝা গিয়েছিল তখন। বস্তুত ঝড়ের চোখ (নজর) এর আগে তেমন ভাবে কোলকাতার উপর এসে পড়েনি, শুধু লেজের ঝাপটা মেরেছে।

ঝড়ের ধাক্কা খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যারা, তারা বাংলাদেশ। এমনকি সে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন কেও উস্কে দিয়েছিল ‘১৯৭০-ভোলা ঘূর্নিঝড়’। দেড় থেকে দু লাখ মানুষ মারা যান তৎক্ষণাৎ। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও তৎকালীন পাক সরকারের উদাসীনতা; পরোক্ষে স্বাধিকারের বাসনাকেই প্রবল করে তোলে।

যদিও একথাও মনে রাখতে হবে ঘূর্নিঝড় আবহাওয়ার এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে আর উত্তরে বিপরীত দিকে বায়ুর এই চলন, পৃথিবীর তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই অতি উৎসাহী বিজ্ঞানীদের সাগরের জলের উপর তেল বা রাসায়নিক ছড়িয়ে বাস্পীভবনের হার কমানো বা বাতাসের গতি কমানোর প্রচেষ্টা বৃহত্তর সময়ে সুখকর নাও হতে পারে। উল্টে সমুদ্র-দূষণ বা ঝড়ের দিক পরিবর্তনের মতো সমস্যা প্রকট হয়ে উঠতে পারে। বরং উপযুক্ত সতর্কীকরণ, ত্রাণ ও পরিকাঠামো উন্নয়ন, বিশেষত ‘উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প’ প্রকৃতিকে সামলানোর প্রকৃত পথ বলে মনে হয়।   


    

Post a Comment

1 Comments

  1. নামকরণের কাহিনী টি বেশ!

    ReplyDelete