ব্লগ : চিত্ররূপময়/ ৪। হেমন্ত শ্রোতাদের বশ করে রাখতেন


হেমন্ত শ্রোতাদের বশ করে রাখতেন

সুমন গুণ

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা আধুনিক গানের সেই পর্বের কুশীলব, যখন কথা নয়, সুর আর গায়কীর দাপট গ্রাস করে নিয়েছে শ্রোতাকে। অন্য কিছু নিয়ে ভাবার মুহূর্তই তৈরি হত না। হেমন্ত শ্রোতাদের বশ করে রাখতে পারতেন, উত্তমকুমার যেভাবে রাখতেন দর্শকদের। ফলে ‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু...’ বা ‘জানিতে যদি গো তুমি, পাষানে কী ব্যথা আছে, গোপন বাণীটি তারই, তোমার পরশ যাচে...’ জাতীয় গানের কথা আদৌ কিছু বলছে কিনা সেদিকে আমাদের মন জাগ্রতই হল না। বাংলা গান যে কবিতার হাত যোগ্যতার সঙ্গে ধরে রাখতে পারল না, তার একটাই কারণ। রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সময়ের  গুণী কবি-সুরকারদের যে-উচ্চতা, বা আমাদের সময়ে, ক্ষণে ক্ষণে সরলবর্গীয় চঞ্চলতা নিয়েও কবীর সুমনের যে-প্রতিভা, তার কাছাকাছি মাপের আর কাউকে বাংলা গান পায়নি। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের অক্ষম অনুপ্রাসে আর কবীর সুমনের উজ্জ্বল উচ্ছিষ্ট নিয়ে বাকিরা রোজগার করে গেলেন।

পরমানন্দ সরস্বতীর লেখা কিছু গান গেয়েছিলেন হেমন্ত, সেই গানগুলো আর সলিল চৌধুরীর গানগুলিই বাংলায় বাণীর দিক থেকে হেমন্তের সবচেয়ে বড়ো দান। সুকান্তর অনেক কবিতায় সুর দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরী, যার বেশির ভাগটাই হেমন্তর গাওয়া। এটা বাংলা কবিতার একটি ঈর্ষণীয় পর্ব। চাঁদ-ফুল-পাখি-মেঘ-চাতক-ফাগুনসর্বস্ব বাংলা গানের সত্যি অর্থে আধুনিক পর্ব। আইপিটিএর সূত্রে হেমন্ত-সলিলের সখ্য বাংলা গানে বেশ কিছু দিনের জন্য একটা আশ্চর্য দ্বীপ তৈরি করেছিল, যেখানে সচেতন মানুষ এসে কিছুক্ষণের জন্য থামতে পারেন, চারপাশে আবর্জনাময় তরল পার হয়ে এসে অন্তত সেই সময়ের জন্য এটাই ছিল বাংলা গানের স্বর্গভূমি। কথা আর সুর স্বাভাবিকভাবে মিলে গেলে কতটা বিস্ময়কর সৃষ্টি হতে পারে, ‘গাঁয়ের বধূ’ তার উদাহরণ। রূপকথা নয় সে নয় বলেও রূপকথারই বিকল্প আদলে রাজনীতি-অর্থনীতির থাবায় কীভাবে কালো হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার মানুষ, তা এই গানে ধরা আছে। সুরের সক্ষম ওঠাপড়া তো আছেই, কিন্তু লক্ষণীয় তা কথার চলনের সঙ্গে চলছে। আর হেমন্তর দাপুটে গায়কী তাকে সঙ্গত দিয়েছে অতুলনীয়ভাবে। রানার সম্পর্কেও একই কথা। কবীর সুমন এই গানে কথা আর সুরের চলন নিয়ে মননময় একটি আলোচনা করেছিলেন, দেখিয়েছিলেন শব্দে শব্দে কীভাবে বদলে যাচ্ছে সুর, সুরের পাণিপ্রার্থী হয়ে কীভাবে এগিয়ে আসছে কথা। হেমন্তর কন্ঠ ছাড়া এই বাগদানের শুভ সম্প্রদান আর কে করবে!

পাশাপাশি, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত সহ বাংলা গানের প্রতিষ্ঠিত গীতিকারদের লেখা গানও অজস্র গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এটা একটু আশ্চর্যই লাগে ভাবলে যে সুকান্ত ভট্টাচার্য, সলিল চৌধুরীর অর্থময় কথার পাশাপাশি তথাকথিত ‘গীতিকার’দের গানও সমান মনোযোগে গাইতে পারতেন তিনি! সেইসব গানের সবকিছুই যে নীরক্ত, তা অবশ্য নয়। কয়েকটি গানের কিছু কিছু অংশ বেশ সাবলীল বলে এখনও মনে হয়। যেমন অসীমা মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘তুমি যাবেই চলে আমি জানতাম...’। এই গানের একটি অংশ : ‘আমি দেখতাম আমি দেখতাম, একটু একটু করে ভুল, ভুলের প্রাসাদ গড়ে তুলছে, সে প্রাসাদ হাওয়া লেগে দুলছে...’।  বা সেই বিখ্যাত গান : ‘কতদিন পরে এলে, একটু বোসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোনো...’। এই গানের একটি সপ্রতিভ অংশ : ‘ জীবনের যে পথ আমার ছিল গো তোমার ছায়ায় আঁকা, সেই পথ তেমনি আছে সবুজ ঘাসে ঢাকা...’। আরেকটি বিখ্যাত গান শুনতে মন্দ লাগে না : ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি...’। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গানটি এর পরে এই ঝকঝকে ধরন আর ধরে রাখতে পারেনি।  

একটি সাক্ষাৎকারে হেমন্ত একটি গানের কথা বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে খুব ভালো গান হওয়া সত্ত্বেও গানটা সেভাবে চলল না । গানটি হল : ‘ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায়, কে তোমায় নিয়ে যায় দূর অজানায়, বলো না আমায়...’। ‘আয় খুকু আয়...’ গানটির কিছু জায়গাও স্বাভাবিক। ‘কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে, বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না, জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা, মনে হয় বাবার মত কেউ বলে না...’। সহজ আন্তরিকতার এই ধরনটিই গানটির সাফল্যের কারণ। 


কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের কথায় ‘শাপমোচন’ ছবিতে অনেকগুলো গান গেয়েছিলেন হেমন্ত। প্রতিটি গানই চমৎকার, বিশেষ করে এই গানটি তো নিখুঁত কবিতা হিশেবেই পড়া যায় : ‘শোনো বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের উপকথা, ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা...’।  এই ছবির অন্য গানগুলোও মনে রাখার মতো : ‘ঝড় উঠেছে, বাউল বাতাস...’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা...’। আর একটি জনপ্রিয় গান : ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো...’। ‘হারানো সুর’ ছবির গান। এর একটি উজ্জ্বল অংশ : ‘তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি, আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে...’।  এমনই উচ্চাশাহীন এই গানটিও : ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না, নীরবে শুধু রইলে চেয়ে, কিছু কি বলার ছিল না...’। সুরের গমকে ভরে উঠেছে এই গানটিও :    ‘তুমি এলে, অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল...’। 


Post a Comment

0 Comments