পান্থ : চিলাপাতায় দিনযাপন


চিলাপাতায় দিনযাপন

সুকন্যা দত্ত

‘‘গহন অরণ্যে আর বারবার একা যেতে সাধ হয় না-

তবু যেতে হয়

বারবার ফিরে যেতে হয়”....

অরণ্যের হাতছানি পেয়ে মন বাঁধা মানতে নারাজ। সবুজের আদিমতা, গহীন অরণ্যের রহস্যময়তা, বুনো ফুলের গন্ধ, নির্জনতা ভেদী পাখির কলতান প্রকৃতির কোলে বৈচিত্র্যের পটচিত্র রচনা করে। জঙ্গলের কাছে গেলে আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, বার বার। অরণ্য যত গভীর হয়, ততই তার রহস্যময়তা বাড়ে। নিবিড় অরণ্যে সূর্যের আলো অনেক কষ্টে পাতার চাঁদোয়া সরিয়ে মাটিকে ছুঁতে  আসে, নতজানু হয় মাটির কাছে।

জঙ্গলের শরীরে হাঁটতে হাঁটতেই শোনা যায় পাতার মর্মর ধ্বনি, লেখা হয় আরণ্যিক নোটবই। ২০১৯ সালে আমরা গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের চিলাপাতা জঙ্গলে। ঝান্ডি থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার যাত্রা শেষে পৌঁছোলাম চিলাপাতায়। ঝান্ডির মায়াবী পাহাড়ী পথের পর ধীরে ধীরে চা বাগানের গা ঘেষে কালিংপং জেলা থেকে ঝপ করে সমতলে এলেই মনে হবে সত্যিই, আলেকজান্ডার ঠিকই বলেছিলেন, “সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ”।

এখানে এসেই মনে হল, পাহাড়ের ধূসরতা মিলিয়ে গেলে আদিম সবুজে। সজীবতা এখানে বিপন্ন বোধ করে না। চিলাপাতা নামটার মধ্যেই একটা ইতিহাস মিশে আছে। কোচবিহারের কোচ রাজবংশের যোদ্ধা ও সেনাপতি চিলারায় নাকি চিলের মতো ছোঁ মেরে শত্রুদের পরাস্ত করতেন। সেই থেকেই এই অরন্যের নাম চিলাপাতা৷ এই অরণ্যের এক  দিনরাত্রির গল্প শোনাবো আজ। জলদাপাড়া ওয়াইল্ড লাইফ সেঞ্চুরি ও বক্সা টাইগার রিজার্ভের মাঝের হাতি চলাচলের সবুজ পথটাই হল চিলাপাতা অরণ্য। আমরা চিলাপাতায় যখন পৌঁছোই  তখন ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১২টা বাজে। চিলাপাতা জঙ্গল ক্যাম্পে আগে থেকেই আমাদের বুকিং করা ছিলো। দোতলার  ঘরে  জিনিসপত্র রেখেই আমরা চলে আসলাম খাওয়ার জায়গায়। পেটে তখন ছুঁচো ব্যায়াম করছে। ক্যাম্পের  একজন নদীর বোরোলি মাছের ঝোল, দেশী মুরগীর মাংস কাঁসার থালায় পরিবেশন করলো।

দুপুরে একটু জিরিয়ে নিয়েই বিকেলে চা খেয়ে জঙ্গল ক্যাম্পের ভিতর ঘুরতে লাগলাম। আজ আমাদের বিশ্রামের পালা। ক্যাম্পের প্রধান দরজার ঠিক বিপরীতে শ্যামল ধানের জমি, দূরে কুয়াশা ধানের মাথায় যেন চাদর বিছিয়ে রেখেছে। হঠাৎ কানে এলো ক্যানেস্তারা পিটানোর শব্দ। ওখানকার একজন জানালেন, হঠাৎ হাতিরা দল বেঁধে ফসলের ক্ষেতে ঢুকে পড়লে, তাদের তাড়ানোর জন্য ওই বিশেষ জিনিসটা বাজানো হয়। দুদিন আগেই সামনের এই ক্ষেতে ও একটা হাতির দল এসেছিলো। শুনেই একটু চমকে উঠলাম। পরদিন সকালে আমাদের জঙ্গল সাফারি। রাতের ঘুম সেরে পরদিন সকাল ৬ টায় আমরা জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা যে সময় চিলাপাতা জঙ্গলে গিয়েছিলাম, সেটা ছিলো অক্টোবর। ২০১৯ সালের অক্টোবার মাসে আমরা যাওয়ার কয়েকদিন আগে উত্তরবঙ্গে ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিল। জঙ্গলে পৌঁছাতেই চোখে পড়লো ভিজের মাটির ক্যানভাস। কাদা মাটিতে নানান নক্সা কেটে গেছে আমাদের আগের যাত্রীবাহী গাড়ি।


ভোরে অরণ্যের  গাছের পাতা থেকে কুয়াশা চুঁইয়ে পড়ছে মাথায়, গায়ে। মনে হচ্ছে গত রাতে গাছেরা যেন এখানে বৃষ্টিযাপন করেছে। আমাদের গাড়ী জঙ্গলের বুক চিরে চলেছে গভীর থেকে গভীরে, পথ পেয়ে ও পথ হারিয়ে ডুবে যাচ্ছিলাম অরণ্যের শাল,সেগুণ,শিরিষ,খয়ের, দেবদারু বহেরার আড়ালে। আমাদের চোখ তখন ঘুরে চলেছে ডান থেকে বায়ে, যদি গন্ডার বা বাইসনের দেখা পাই, নিদেনপক্ষে একটা হরিণ বা হাতি তো আশা করতেই পারি, তাই না?

একটু একটু করে সূর্য নিজের ঘুম থেকে উঠছে আর পাতার ফাঁক ফোকড় থেকে উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ ডানে নজরে  পড়লো নল রাজার গড়, অবশ্য একে ভগ্নাবশেষ বলা যেতে পারে। শোনা যায়, ভুটান রাজার হাত থেকে রক্ষা পেতে কোচবিহারের রাজার সৈন্যরা এই দূর্গে থাকতেন এবং বানিয়ে নদী দিয়ে চলাচল করতেন। দুর্গের চারপাশেই রামগুণা গাছ দেখতে পেলাম যার গায়ে আঘাত করলে লাল রক্তের মতো রস নিঃসৃত হয়। এই সব ভগ্নাবশেষ প্রাচীন সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আজ সে স্তব্ধ হলে ও একসময় ছিলো নানান জীবন্ত কাহিনীর বাস্তব দিলল।

আর ও কিছুটা গভীরে যেতেই গাইড হঠাৎ গাড়ীটা দাঁড় করিয়ে ইশারায় বোঝালেন, ডান দিকে বাইসন দাঁড়িয়ে আছে। তবে আর ও কিছু গাড়ি শব্দে বাইসন দর্শনের সুযোগ দীর্ঘ স্থায়ী হলো না। আবার চলতে লাগলাম আমরা, এবার জঙ্গল থেকে বাইরে বেরোনোর পালা। বৃষ্টিভেজা মাটির পথে একটু একটু করে গাড়ী ছুটে চলেছে। হরিণ, বন্য ময়ূর দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, হাতির দেখা পেলে মন্দ হতো না।

কিছুটা যেতেই দেখি একটা বিরাট বাজ পাখি গাছের ডালে চুপ করে বসে আছে। আমরাও নিঃশব্দে তাকে ক্যামেরাবন্দি করলাম। ততক্ষণে সকাল বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। চোখে পড়লো এক মাহুত দুটো হাতিকে খাবার খাওয়াচ্ছে। দেখেই মনটা আনন্দে দুলে উঠলো, যাক ঐরাবতের সাক্ষাৎ তো পেলাম। অরণ্যের শরীরে বয়ে চলার এই অভিঅভিজ্ঞতা আজীবন মনের চিলেকোঠায় বন্দি হয়ে থাকবে। কান পাতলে নির্জনতা ও এখানে গল্প লিখে যায়, ঝিঁঝি পোকা এখানে জলসাঘর বসানোর জন্য সন্ধ্যার অপেক্ষা করে না। ছায়া শীতল অরণ্য পেতেই আমি বার বার ভবঘুরে হতে চাই।

Post a Comment

0 Comments