ব্লগ : চিত্ররূপময়/ ৫। তাঁর বেঁচে থাকার মতোই বেপরোয়া তাঁর কবিতা



বেঁচে থাকার মতোই বেপরোয়া তাঁর কবিতা

সুমন গুণ

বাংলা কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের একটি স্পষ্ট আর প্রকাশ্য অবস্থান আছে। সহজ কথা সরাসরি বলার মধ্যে অনেক ঝুঁকি থাকে। সারা পৃথিবীতেই সহজে লক্ষ্যভেদী বহু কবিতা লেখা হয়েছে, বাংলাতেও সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার থেকে শুরু করে এই সময় পর্যন্ত এমন অনেক কবির লেখাই আমরা পড়েছি, কৌণিক কোনও ধরন না রেখেও যাঁরা সফল হতে পেরেছেন। নির্মলেন্দু গুণ এই ঘরানার,  সম্ভবত, জনপ্রিয়তম কবি।

'সুন্দর এসে থেমে আছে তার

নাসিকার শেষ প্রান্তে

নাকপাশা যেন সোনা দিয়ে মোড়া

ঘুঘু চোখ ঘুমে বুঁদ,

অথবা শীতের পিঁপড়ের মুখে

আলতা মাখানো খুদ।

আমার জীবন যাবে আজীবন

তোমার জীবন জানতে।'

কবিতাটিতে নিরভিমান মায়া মাখানো, ঈষৎ আর্দ্রতাও যে আছে, সে-কথাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এই ছোটোকবিতাটির আসল জোর দু’জায়গায়। প্রায় উলটো দুটি প্রবণতার জোরে লেখাটি উড়াল দিতে  পেরেছে। একই সঙ্গে এখানে প্রতিটি শব্দ অবধারিত, একটি শব্দকেও এড়িয়ে যাবার জো নেই; আবার, কিছু শব্দ অকারণে বেজে উঠে অতিরিক্ত একটা ঘোর তৈরি করতে পেরেছে । একই সঙ্গে এই দুটি লক্ষ্য সফলভাবে মিলে যাওয়ায় কবিতাটি পড়তে পড়তে বিভ্রান্তির পুলক লাগে মনে, কিছু একটা ঘটছে টের পাওয়া যায়, আর অধরা সম্ভাবনার টানে হাত বাড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।

'আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু প্রাপ্য ছিল,

একখানা ঘর সবার মতো আপন করে পাবার,

একখানা ঘর বিবাহিত, স্বপ্ন ছিল রোজ সকালে

একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার'

এখানে তো কোনও প্রত্যক্ষ ঘটনার কথা বলা নেই, কিন্তু ‘বিবাহিত’ ‘ঘর’-এর যে-‘স্বপ্ন’-এর  কথা বলা হলো এখানে, যা কবি প্রবলভাবে নিজের ‘প্রাপ্য’ বলে বিশ্বাস করেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির  নাছোড় সম্পর্কটি টের পেতে আমাদের অসুবিধে হয় না। বিশেষভাবে লক্ষণীয় শেষ লাইনটির অবধারিত সরলতাটুকু, গোটা কবিতাটির মর্ম যা করতলগত করে রেখেছে।

নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বৈশিষ্ট্য এই সরল, স্বাভাবিক আর উজ্জ্বল মুখরতায়। বানিয়ে কিছু বলতে পারেন না তিনি, বলতে চানও না। তাঁর বেঁচে থাকার মতোই বেপরোয়া তাঁর কবিতা।

Post a Comment

0 Comments