ব্লগ : স্বগতোক্তি/১৭ । ভাল দিন আমরা বানিয়ে নেব




ভাল দিন আমরা বানিয়ে নেব

তড়িৎ রায়চৌধুরী 

আমরা যখন টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করি তখন ভেঙ্কসরকারদের পালা শেষ করে রবি শাস্ত্রীরা আসছেন। ব্যাটসম্যান জোরে হিট করলে শর্টের ফিল্ডার হেঁকে দিতেন, আর বাউন্ডারি লাইনের ফিল্ডার অপেক্ষা করতে, বল কাছে আসবে বলে। তারপর হাঁটু মুড়ে বসে, বল ধর্‌ দু’বার টিপ করে, ছুঁড়ে দিতেন। ক্রমে দিন বদলালো। চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ল। পোশাক রঙিন হল। এখন আর কেউ অপেক্ষা করে না। ছুটে এসে চলন্ত বলকেই তুলে ছুঁড়ে দেয় উইকেটের দিকে। খেলা বদলে গেছে। দুনিয়া এখন বিশ্বাস করে, টান মারো খেলা ঘুরবে।

করোনার প্রথম হল, দ্বিতীয় হল, শোনা যাচ্ছে মাস দুয়েক পরে তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। সমুদ্রের মতো। অন্তহীন ঢেউ। আমরা তবু আচ্ছে দিনের অপেক্ষায়। আবার কবে ফিরবে মুখোমুখি বসিবার কাল। কাল গিয়ে মহাকালে ঠেকার যোগাড়। বরং এবার হয়তো টান মেরে খেলা ঘোরানোর সময়। বল আমাদের কাছে আসবে বলে প্রতীক্ষা নয়। আমরাই এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরব। ভাল দিন আসার অপেক্ষা নয়, এবার ভাল দিন আমরা বানিয়ে নেব।

এমনিতেই এই করোনা কাল কে পাসিং ফেজ ভাবতে ভালো লাগে না। এতো মৃত্যু, এতো অভিজ্ঞতা, এতো লড়াই সব কিছু জলের দাগের মতো মুছে যাবে মন থেকে! এ আমি ভাবতেও পারি না। বরং দহনেই যেমন রূপান্তর হয় আমি তেমনি নতুন দিন দেখতে চাই, পুরাতনের পুনরাবর্তন নয়। ডেট লাইনে BC (বিফোর করোনা) AC (আফটার করোনা) যেন নতুন তাৎপর্য নিয়ে আসে।

সভ্যতার বিবর্তনে আমরা তো অনেক কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে নিয়েছি। আদিম যুগে মানুষ ছিল পোশাকহীন নগ্ন। প্রাকৃতিক বিপদ থেকে বাঁচতে, শরীরের আরামের স্বার্থে সে মেনে নিয়েছে পোশাকের পরাধীনতা। অথচ পোশাক তো দূর অস্ত বাঘের গলায় কলার পড়ালেও সে তা শরীরে ধারণ করে থাকতে চায় না। একদিন নদীর পাশে, তারা ভরা আকাশের নিচে গাছের ডালে নিশি যাপনের অভ্যাস মানুষ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছে। ঘর বাড়ি কাঠ কংক্রিট বাস্তু শিল্পে তার ক্রমিক জটিলতা দেখার মতো। 

এখন পোশাকের পরাধীনতা বা গ্রাম শহরের বন্দীত্বের কথা বললে সবাই অবাক হয়ে পড়বে। যেন খোদ সভ্যতাকেই অস্বীকার করতে চাইছি মন হবে। সেদিন ঠান্ডার জন্য পোশাক পড়েছে মানুষ আজ ভাইরাসের জন্য মাস্ক। সেদিন আক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘর বানিয়েছিল আজ সংক্রমণের বিপদে থাকছে অন্দরে। যে জীবন বাঘেদের, পাখিদের তার সাথে মানুষের হয় নাকো দেখা। তারা সেদিনও পোশাক পড়েনি, আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতিউতি। শুয়ে শুয়ে আকাশ-বাতাস-বৃষ্টি কে আর পাই না আগের মতো। তাই নিয়ে কি মন খারাপ করে মরি?  তাহলে পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য আজ নতুন এক বর্ম-ব্যবস্থা ; ভিন্ন এক যাপন ছন্দ মানব এই সরল সত্যটুকু স্বীকারের ভুলে আর কতদিন মন মুষড়ে থাকব আমরা? নাকি নতুন এই ব্যবস্থা কেই ভাবব, দেখব, উপভোগ করব চুটিয়ে? খুঁজে দেখব জীবনের গতি কেমন হৈ হৈ করে বয়ে যাচ্ছে নতুন ছন্দে। আচমকা ধাক্কায় প্রথমে হয়তো একটু চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন আর সে অবস্থা নেই। এখন নবযুগের সময়। নতুন দিন, নতুন জীবন, নতুন কে বরণ করার লগ্ন। 

বহুদিন আগে এক ৭ পৌষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “নবযুগ আসে বড়ো দুঃখের মধ্য দিয়ে। এত আঘাত এত অপমান বিধাতা আমাদের দিতেন না,যদি এর প্রয়োজন না থাকত। অসহ্য বেদনায় আমাদের প্রায়শ্চিত্ত চলছে, এখনো তার শেষ হয় নি। কোনো বাহ্য পদ্ধতিতে পরের কাছে ভিক্ষা করে আমরা স্বাধীনতা পাব না;কোনো সত্যকেই এমন করে পাওয়া যায় না”। নিশ্চয় সে প্রসঙ্গ ছিল ভিন্ন। তবু অন্তর্গত মিলটুকু তো সত্য। দুর্গতির রাতে কোন বাইরের ভিক্ষার অপেক্ষায় থেকে নয় নিজেদের জোরে দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচকতায় আমরা নতুন কে খুঁজে পাব। এই জোর ছিল বলেই হয়তো সমগ্র দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভাবতে পেরেছিলেন চরকার যুগ ফিরবে না। ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘোরে না। নতুন যুগ আসে।

আমরা কি তাঁর একটুও উত্তরাধিকার বহন করি না?        

Post a Comment

0 Comments