ব্লগ : চিত্ররূপময়/ ৬। নিবিষ্টতাই আলোক সরকারের স্বর


নিবিষ্টতাই আলোক সরকারের স্বর

সুমন গুণ 

নিঃশব্দের ভাষায় যাঁরা কবিতা লিখেছেন, বাংলায়, এখনও পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে সবার আগে মনে আসে আলোক সরকারের নাম। কোনও কিছু হয়ে ওঠা নয়, না-হয়ে ওঠাও নয় তাঁর কবিতা। বিশুদ্ধ শব্দটির  নানারকম ছায়া আছে, জটিলতা আছে, অর্থান্তর আছে। কিন্তু এই শব্দটি আলোক সরকারের কবিতার সঙ্গে কত তর্কাতীতভাবে মানিয়ে যায়! অন্য কোনও কবি, এমনকি জীবনানন্দ প্রসঙ্গেও বিশুদ্ধতার ধারণাটি এমন সমতলভাবে স্মরণীয় মনে হয় না।        

এখানে আলোক সরকারের সেই সুখ্যাত কথাটি মনে পড়বে : বন্যায় যে বিপর্যয় হয়, তার বিবরণ দেয় খবরের কাগজ; আর এই বিপর্যয়ে আমার মনখারাপটুকু ধরে রাখে কবিতা। এই অর্থেই বিশুদ্ধতার  ধারণাটি আলোক সরকারের কবিতা প্রসঙ্গে মানে পেয়ে যায়।

বিশুদ্ধতার রকমটি নিয়ে একটু কথা বলা জরুরি। বিশ্বের নানা সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে এই ধারণাটি কোনও-না-কোনওভাবে যুক্ত থেকেছে। সুররিয়েলিস্টিক আয়োজনটির সঙ্গেও বিশেষভাবে। ব্রেঁতোর কথা মনে পড়বে, যিনি বলেছিলেন অতিরিক্ত সব অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু ভাবনার তরঙ্গটি পড়ে থাকবে কবিতায়, বন্ধ দরজার নিচে মুখর আলোর রেখা যেমন, ঘরের রহস্য আর সম্ভাবনার সবটুকু ওই রেখায় সমর্পিত।

জীবনের শেষতম পর্ব পর্যন্ত আলোক সরকারের কবিতা এই আলোকরেখাটির বেশি আর কিছুই হয়ে উঠতে চায়নি। এই একাগ্রতার সুফল বাংলা কবিতায় থরে থরে ফলে উঠেছে। 

নিবিষ্টতা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তাঁর, তাঁর কবিতার। ফলে এমন কবিতা একটাও পাওয়া যাবে না আলোক সরকারের, যা উদবৃত্ত, আরোপিত। আসক্তির মাত্রায় তর-তম থাকতে পারে, শব্দনির্বাচনে এদিক-ওদিক হতে পারে, কিন্তু উৎসে কোনও খাদ নেই, বহমানতায় টোল নেই।

এটা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। এত কোলাহল, এত বাসনা, এত চোরাটান, এত গুপ্তক্ষতভরা আমাদের জীবন যে অনুভূতির গোমতী দিয়ে লেখাকে বাঁচিয়ে  বাঁচিয়ে নিয়ে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। কোথাও না কোথাও পারে পা ঠেকবেই, ধারের রেললাইন থেকে ডাক আসবে, নতুন রিসর্টের আলো কিছুক্ষণ মশগুল রাখবে। এমনকি জীবনানন্দও থাকতে পারেননি, চেঁচিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা...’! এটা তো কবিতার ভাষা নয়, বিরক্ত কবির উক্তি। 

কিংবা, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ...’। এটাও আহত নাগরিকের  খেদোক্তি। এই স্তর থেকেও কবিতা লেখা হয়, কিন্তু আলোক সরকার যে-গ্রামে তার বেঁধে রেখেছিলেন, সেখানে এসবের প্রবেশাধিকার নেই। 

Post a Comment

0 Comments