জেলের চিঠি, কবির ক্ষত


জেলের চিঠি, কবির ক্ষত

অভিমণ্যু পাঠক 


বাদশাহ্‌ বাহাদুর শাহ্‌ জাফর তাঁর জীবন সায়াহ্নে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, জীবনে বাড়তি যে চারদিন ভিক্ষা করতে চেয়ে নিয়েছিলেন, দু’দিন হারিয়ে গেছিল আশায়-আশায়, আর বাকিটা অপেক্ষায়। আরও আশা আরও অপেক্ষাকে ডেকে আনে, প্রশ্রয় দেয়। যেখানে কাজ খুব বাঁধাধরা, নেই বললেই চলে, সেখানে সময় পিছলে যায়, হাতের আঙুলের ফাঁক গলে, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। জেলের ভেতরের জীবনটা খানিকটা তেমনই। এমন করেই তাঁর জেলের স্মৃতিকথার বয়ানের ডালি সাজিয়েছেন, ভারভারা রাও তাঁর, ‘Captive Imagination: Letters from Prison’ বইয়ে। 

অন্যের মুখের ঝাল না খেয়ে বেশীরভাগ কথা শুনব, তাঁর বয়ানে। কারণ তাঁর শব্দবন্ধের মধ্যে আলো-আঁধারি খেলা, মন্দ্রতা আর স্থির চিত্রমালার কোলাজ।

২০১৮ থেকে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় প্রায় তিন বছর জেলে বন্দি ছিলেন তেলেগু ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, সমাজকর্মী ভারভারা রাও। এই বছর ৬ মার্চ, মধ্যরাত্রিতে শর্তসাপেক্ষ জামিনে ছয় মাসের জন্য অসুস্থ ও অশীতিপর কবি মুক্ত হয়েছেন। তাঁর মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীরা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলেন। অশীতিপর কবি স্মৃতিভ্রংশ বা ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত। মূত্রথলিতে  সংক্রমণ হয়েছিল, শৌচালয় যাওয়া তো দূরস্থান, বিছানা ছাড়তেও পারছিলেন না। কোভিডেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। মুম্বইয়ের তালোজা জেলে তিনি বন্দি ছিলেন।

ভারাভারা রাও, কবি পরিচয়ের ব্যতীত তিনি ছিলেন অধ্যাপক। ১৯৮৮ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। সাতের দশক থেকে দু হাজার একুশ পর্যন্ত, জীবনের একটা বড় অংশ, মহামূল্যবান সময়, তাঁর নষ্ট হয়েছে জেলের অভ্যন্তরে বন্দিত্বে এবং অপেক্ষায়। তা সত্বেও কীভাবে নিজের দুর্দম প্রাণের বহ্নি দিয়ে অন্তরে জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিলেন অনির্বাণ শিখা, গোপন অব্যর্থ সন্ধানে অন্ধকারে জাগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন কবিতার অনন্ত নক্ষত্রবীথির ছায়াপথ, তা বিস্ময়ের। কারাবাসের সেইসব দুঃসহ দিনগুলি-রাতগুলি নিয়ে দিনলিপির আকারে  তেলেগুতে লিখেছিলেন বিতর্কিত ‘সহচারুলু’ শিরোনামের বই। সেই বই নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে আমরা খোঁজ পেয়েছি তাঁর অন্ধকারের অন্দরে অপেক্ষায় জায়মান ভাবনা ভুবনের।

যেহেতু জেলের মধ্যের দুনিয়ার সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার সংযোগ, মাপা, বাইরের অভ্যেসগুলি সেখানে অনুপস্থিত নয় বরং বাইরে অনুপস্থিত ব্যাক্তিটি নিজেই। তাই বন্দিত্বে মানুষটি পরিণত হয়ে ওঠেন, দর্শকে। যে দর্শক বর্তমানের ইশাদি, অতীতের চিহ্নস্বরূপ। সময় প্রতি মুহূর্তে চুপ করে মনে করায়, মনে পড়ে নানা কিছু।

সকালে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়া। আপাতত, নব্বই পূর্ববর্তী সময়ের কথা লিখছেন ভারভারা। সাল ১৯৮৮, তখন অনুষ্ঠিত হচ্চিল, সিওল অলিম্পিক। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বন্দি থাকা কবির অন্য বন্দীদের সঙ্গে মেশার অনুমতি ছিল না। 

অলিম্পিকের সূত্রে জেলে বন্দোবস্ত হয়েছে একটি টিভি’র, সেখানে বন্দিরা খেলা দেখবেন। চ্যানেল বলতে, দূরদর্শন। ট্রান্সমিশনের সময় বাঁধা। ৫.৩০-এ টিভি স্ক্রিন নীল হয়ে সম্প্রসারন বন্ধ হয়। পরের সম্প্রসারন আবার ৫.৪৫-এ। টিভির পর্দায় গুনতি চলতে থাকে, যেন বালিঘড়িতে ঝরছে সময়, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪… প্রতি মুহূর্তে, এইভাবেই বালিঘড়িতে সময় বয়ে চলে, বাকীরা চুপ। এই টিক-টক-টিক-টক করে এগিয়ে চলা সময়, কবি ভারাভারার মনে এনে দেয় একটা ইমেজারির। নীল আকাশের বুকে একটা পাখির উড়াল। উড়ছে সে আকাশের অনেক গভীরে, জায়মান শুন্যতার মধ্যে, গাঢ় নীলের মধ্যে, কিন্তু নীচ থেকে, দূর থেকে দেখলে, মনে হয়, সে যেন নিস্পন্দ, স্থির। সময় থমকেছে, কিন্তু আলগোছে বয়ে চলে সময়। 

ভারভারা প্রশ্ন করেন, সরাসরি, কখনও সেকেন্ড গুনেছেন আপনারা? ভেবে দেখেছেন সেকেন্ডের অস্তিত্ব! সে এমন আর কি! চোখের পাতা পড়ার মুহূর্তেই জীবন থেকে ঝরে যায় এক একটা সেকেন্ড।

তারপর খানিক হাল্কা ছলে বলেন, প্রেম করেছেন নিশ্চয়! প্রেম ছাড়া কোথাও সময় মাপার বা গোনার দরকার পড়েনা। কতদিন পর দেখা হবে! কতক্ষণের জন্য হবে! দেখা হতে আর কতটুকু সময় বাকী? কতক্ষণ আগে পৌঁছে সে অপেক্ষা করছে, এইরকম নানাবিধ হিসেব চলে।

তারপর বলেন বন্দিত্বের অপেক্ষা নিয়ে তাঁর উপলব্ধি, প্রেমে প্রগাঢ় অপেক্ষা আছে। সেখানের অপেক্ষার স্পৃহা পূর্ণ হয়ে থাকে মধুর তৃষা নিয়ে। জেলের মধ্যে অপেক্ষা করতে প্রথম হয় বিরক্তি, ক্রমশ অভ্যেস, কালক্রমে নেশায় রূপান্তরিত হয়। অবান্তর তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের জন্যও মানুষ জেলে অন্তহীন অপেক্ষা করে, করতে বাধ্য হয়, তাই একসময়ে ভালোওবাসে। এখানে সময় নিঃস্পন্দ।

কেমন ছিল জেলের প্রাত্যহিক দিন-রুটিন?

সেল থেকে আনলক…চা…স্নান…খিচুড়ি…কয়েক চক্কর জেলের মধ্যেই এদিক সেদিক…আবার সেলে… প্রত্যেকের ধরণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এই লকিং আনলকিং চলে… যাঁরা সশ্রম কারাদণ্ড পেয়েছেন তাঁদের শ্রম দিতে হয়… চা…গুনতি…লকিং— সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই আদতে প্রত্যেক বন্দির দিনযাপনের সূচী।

কিন্তু এত সহজেই কি দিন কাটত? দিন কাটলেও রাত কাটত কি? উত্তরে তিনি জানান,

ঘুম না আসা রাত্তিরগুলোতে, যে অব্যক্ত যন্ত্রণা, যে নিরুচ্চার ব্যথা শব্দের অন্তরালে শুন্যতায় বাসা বেঁধে থাকে, যাকে চিনতে পারলেও, ব্যাখ্যা করা যায়না। কথার সময়ে তারা হয়ে ওঠে নিভন্ত বিড়ির মতো। এখানে সহানুভূতিকে সবাই অগ্রাহ্য করে, এখানে আনন্দ বা দুঃখ ভাগের সুযোগ নেই, বন্দিত্বের কুঠুরি ঘনান্ধকার, ভালবাসা-রহিত।

কিন্তু জেলের বাকী বন্দিদের মতো তাঁর রুটিন ছিলনা, তাহলে কেমন ছিল তাঁর দিনযাপন? 

সেকথা বলেন, আমার প্রাত্যহিক জেলের রুটিন অন্য বন্দিদের মত ছিল না, এমনকি অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মতোও নয়। আমার বন্দিত্ব ছিল সঙ্গীরহিত ও সঙ্গকাতর। এক হাজার রাত্রি ছিলাম, ভয়ঙ্কর ভাবে একক, শুধু আমার সঙ্গে আমি। এই এক হাজার দিনে আমার সঙ্গে কথা বলার, সংযোগের প্রাণী হিসেবে মানুষ ছিলেন যৎসামান্য। পাখি, গাছ, লতাপাতা, আকাশ আমাকে সঙ্গ-সাহচর্য দিত। খবরের কাগজ আসত। বন্ধুরা প্রতি সপ্তাহে বই পাঠাত। স্রেফ বই আর পড়া ছাড়া, আমার জেলের মধ্যে অন্য কোনও কাজ, অবসর কিচ্ছু ছিল না।

কিন্তু এই নিঃসীম ক্লান্তিকর নিদারুণ ভারী পাথরের মতো দিন তিনি ঠেলে পেরতেন কি করে? কোথাও কি একটু হলেও স্মৃতি বা মুক্তির প্রাণবায়ু ছিল, যা নিয়ে তিনি বাঁচতেন?

অবচেতনে সুরসঙ্গতির প্রতিধ্বনিতে বাঁধা থাকত, সেখানে বাজত অপেক্ষার নীরব সুরেলা ধুন… আমার সত্যিই কিছুই ছিলনা যার জন্য অপেক্ষা করতে পারি, সেলের লকিং আর আনলকিং এর মধ্যে সেদিনের খবরের কাগজের জন্য দিন গুজরান করতাম। সেলে জল আসার জন্য অপেক্ষা করতাম। কোর্টে যাওয়ার সময়ের জন্য অপেক্ষা করতাম। সবসময় কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষা দীর্ঘতর হত, বিকেলের পড়ে আসা ছায়ার মত।

রেডিওর খবরের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাদের ব্লকের রেডিওটা খারাপ হয়ে গেছিল, তাই দূরের সার্কেল রেডিওটা শুনতাম, সেখানে অন্য অনুষ্ঠান হত।

বিকেল হলেই, আমার অপেক্ষার ধার না ধরেই সার্কেল রেডিওতে বিবিধ ভারতী বাজত। খুব নীচু স্বরে বাজত, গান। তাই আমার পড়ার মধ্যেও দিব্যি মাথার মধ্যে গানের ধুন এসে মিলত। অনুরোধের আসর চলত। 

সুর কি স্মৃতি ডেকে আনে, অথবা স্মৃতিতে প্রলেপ দেয় শ্রুশুষার? গানের সঙ্গে তাঁর মনে পড়ার এক সেতু ও সংযোগের গল্প বলেন কবি ভারভারা,

যখন ‘চৌধবি কা চাঁদ হো ইয়া আফতাব হো’ বাজত, মনে হত, চাইলে আমি এই পড়ে আসা বিকেলের আলোর সঙ্গে পুনরায় বন্ধুত্ব করতে পারি। বাজত, ‘আধা হ্যায় চন্দ্রমা রাত আধি’, কয়েক মুহূর্তের জন্য কোথাও সুদূরে নিয়ে যেত এই গান। ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না, এখন কোন সময়! রাত না দিন! এক দূরাগত স্মৃতি, নিকটবর্তী হত। বিয়ের পর আমার গ্রামে ফিরছি, অর্ধপথে এক ঘাসে ভরা চারণভূমির মধ্যে রাত্রিতে থামতে হয়েছিল। সেই প্রান্তর ছিল আমার আর আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর দুই গ্রামের মাঝে। তখনও আমরা নিজেদের মধ্যে কথা কইতে সড়োগড়ো হইনি, তখনও লজ্জা-দ্বিধায় আমাদের জিভ আড়ষ্ট হয়ে পাথর… রেডিওতে বাজছে, ‘রেহ না যায়ে তেরি মেরি বাত আধি’…

জেলে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। রাতেও প্রতি ঘণ্টায় শোনা যায় সেই ধ্বনি, ঘোষণা দেয়: ‘সব ঠিক হ্যয়!’ ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে’। জেলের মধ্যে নীরবতার ঢেউগুলি জমে জমে এক সংবিগ্ন হ্রদ হয়ে ওঠে।

অপেক্ষা শুনেছি, সুর শুনেছি, ঘুম না আসা রাত্রি শুনেছি কিন্তু এই নিঃসীম নীরবতা অস্বস্তিকর প্রগাঢ় শব্দহীনতা তাঁকে কেমন অনুভূতি দেয়! কি কি মনে করায়?

নীরবতার সেই ঢেউগুলি ক্রমশ জাগিয়ে রাখে, বুনে চলে ব্যাথার রাত্রি, যেন যিশুর নখের ওপর ক্রুশের পেরেক ঠোকার যন্ত্রণার মত। মনে হয় বিখ্যাত আফ্রিকান লেখক এনগুগি ওয়া থিয়াংঙ্গো, আমাকেই প্রত্যয় দেওয়ার জন্য তাঁর ‘প্রিজন ডায়েরি’টি লিখেছিলেন। ক্রমে অনুভব করি, ম্যান্ডেলার কাছে স্বাধীনতা কত মহার্ঘ্য ছিল, যার জন্য তাঁকে অন্ধকার কুঠুরিতে কাটিয়েছিলে, ছাব্বিশ বছর। 

যারা কোনদিনও কোথাও বন্দি থেকেছেন, অন্তত একবেলার জন্য, যাঁদের সেই অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা বুঝবেন, নিরর্থক শ্লথ অপেক্ষা আদতে একটা শাস্তি, জেলে মানুষ অপেক্ষা করে, মুক্তির প্রত্যাশায়।

প্লেটো তাঁর রিপাবলিক নামক কল্পিত রাষ্ট্রে কবিদের নিষিদ্ধ করেছিলেন। কবিরা নাকি প্রচুর বাজে বকে অথবা খালি প্রশ্ন করে। ভারভারা স্রেফ কবি নন, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, বক্তা, অধ্যাপক ফলে তাঁর চেতনা এবং অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবি অনেক বেশী প্রখর।

তাঁর এই দিনলিপি চলতেই থাকবে, এমনই থেমে থেমে, নিজস্ব নির্জন ছন্দের নিয়ম ও আঙ্গিকে। অপেক্ষা, আবার চলা, বিরতি। আবার চলা, বিশ্রাম, আবার…

যে কোনও শাসকের শাসনে, ভারাভারা বারবার হয়েছে, অন্তরীন, বন্দি। তিনি গ্রীক নাটকের কোরাসের মতো নিরন্তর প্রশ্ন করে চলেন, যে কোনও রঙের শাসকের সময়কালেই। তাঁর কবিতায়, ঠিক এভাবে—


...আমি বিস্ফোরকের জোগান দিইনি

দিইনি এমন কোনও ভাবনাও, যা ইন্ধন যোগায়

তুমিই তো সেই, 

যে ধাতব পার্বিত দিয়ে পিষেছ বল্মীক

আর সেই পদদলিত ভূমা থেকেই  

পল্লবিত হয়েছিল প্রতিহিংসার ধারণা


তুমিই তো সেই, যে লাঠি দিয়ে 

ভেঙেছিলে মৌচাক

চারিদিকে পরিক্ষিপ্ত মৌমাছির শব্দে

বিস্ফারে বিস্ফোরিত হয়েছ তোমার মুখোশ

আশঙ্কার আঁচিলে লাল তোমার মুখমণ্ডল

 

যখন জনগণের হৃদকন্দরে

বাজতে শুরু করেছিল জয়ডঙ্কা

তুমি সে সংকেত বুঝেছিলে ভুল, 

তাই বন্দুকগুলোকে শিক্ষিত করেছিল

তারপরেই, 

সমস্ত দিকচক্রবাল জুড়ে বিপ্লব প্রতিধ্বনিত হল।...

Post a Comment

0 Comments