লালাদা



লালাদা

আবীর মুখোপাধ্যায়

মেঘের মিনার ছুঁয়ে রোদ-ছায়ার খেলা চলছে সারা বাগানে। যেন অলস, ‘ঝরা পাতার মতো’ একটি দিন। হাওয়ায় হাওয়ায় সওয়ার হয়ে পাতারা ঝরে পড়ছে। আর পড়ছে। নাম-না-জানা কত রঙিন পাখির ভিড় ‘রবিবার’-এ!

‘‘সে কেন রে করে অপ্রণয়/ তার উচিত নয়,/ জানি আমি তার সনে/ কভু তো বিচ্ছেদ নয়।’’ 

গ্লাসের মধ্যে আগে থেকেই গন্ধরাজ লেবু আর ফালি কাঁচা লঙ্কা ছিল। ভডকা ঢালতেই, অ্যাঙ্গুস্টুরা বিটারসের শিশি খুলে সুরায় মিশিয়ে দিলেন। তারপর, কথা আর কোহল জুড়ে জুড়ে দিনমান। 

হয়তো একটার পর একটা নিধুবাবু গাইছেন প্রিয় লেখক। কখনও ফিরছেন রবীন্দ্রনাথে— ‘‘ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম,/ এখনো তো ভালোবাসি— তবুও কী নাই/ কিছুই তো হল না।/ সেই সব— সেই সব— সেই হাহাকাররব,/ সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা।’’ 

এই মানুষটি ‘মাধুকরী’, ‘হলুদ বসন্ত’ কিংবা ‘একটু উষ্ণতার জন্য’—র লেখক বুদ্ধদেব গুহ নয়। শান্তিনিকেতনে তাঁর ‘রবিবার’ বাড়িতে, তিনি আমাদের প্রিয় লালাদা। সেখানে জঙ্গল আছে, শিকার আছে, লেখক জীবনের স্মৃতির সৌরভ আছে, জর্জ বিশ্বাস আছেন, সত্যজিৎ আছেন, তসলিমার চিঠি আছে, আনন্দবাজার আছে, অভীক সরকার আছেন। কিন্তু, এসবের বাইরে ঘরোয়া একজন মানুষও আছেন। সেখানে তাঁর কোনও আড়াল নেই— দরোজা হাট এক আশ্চর্য জীবন! রবিঠাকুরের গান, চিরসখা ঋতু আর মেহগিনি স্মৃতির দেরাজ খুলে— কত যে ‘রবিবার’ স্মৃতি!

নব্বইয়ে স্কুলবেলা। পুজোর ছুটিতে সেই সেবার-ই প্রথম পড়ে ফেললাম লালাদাকে। বাবার টেবিল থেকে ‘কোজাগর’।

সুধীর মৈত্র’র প্রচ্ছদ। রমাপদ চৌধুরীকে উৎসর্গ। আর আদুল গায়ের, পাহাড়ি মেয়ে। প্রচ্ছদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে পড়ছি আর দেখছি— ‘‘তিতলিকে যেদিন প্রথম ওকে বিয়ে করবার কথাটা বলি, তিতলি অবাক হয়ে গেছিল। ওরা ত চিরদিন ধর্ষিতাই হয়েছে। ওদের মন ব্যবহত-ব্যবহত-ব্যবহত হয়ে, শূকরীর মতো হয়ে গেছে। সে মনে কোনো ভালোবাসার ডাক যেমন আর সাড়া তোলে ; ঘৃণার ধিককারও না। ওদের চোখে পথিবীর অবিশ্বাস। বিশ্বাসকে, কোনোরকম শুভবিশ্বাসকেই বিশ্বাস করার মতো মনের জোর আর ওদের অবশিষ্ট নেই। তাই, তিতলি কথাটা প্রথমে বিশ্বাসই করে নি।’’

সেই শুরু— চার দশক! একে একে ‘আয়নার সামনে’, ‘বাজে চন্দনপুরের কড়চা’, ‘বাংরিপোসির দু রাত্রির’, ‘বাসনাকুসুম’, ‘চবুতরা’, ‘চান ঘরে গান’, ‘চারুমতি’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘ওয়াইকিকি’, ‘কুর্চিবনে গান’, ‘এক ঘরের দুই রাত’, ‘বাবলি’। নিজে হাতে লিখে উপহার দিলেন কত বই— ‘স্পর্শস্বর’, ‘খেলা যখন’, ‘বনবিহারীর স্মৃতিচারণ’। পাঠ নয় অবগাহন!

‘রবিবার’ স্মৃতি মানে — লালাদার সঙ্গে গোঁসাই সুমন আর আমি। কখনও কৃষ্ণনাগরিক রঞ্জন। গল্প-উপন্যাসের পূর্ব-কথা শুনতে চেয়ে তাঁকে কত যে উস্কে দিয়েছি আমরা। কোনওদিন বা মোহরদি, বসন্তোৎসব, পৌষমেলা নিয়ে— বর্ষায়, বসন্তে—ভেসে গেছি শান্তিনিকেতনে তাঁর স্মৃতির সাঁই সাঁই হাওয়ায়! জুঁই স্মৃতির মাঝে অনিবার্য ছিল গান— ‘‘সে এক অন্য শান্তিনিকেতন। সকালে শালমঞ্জরীর গন্ধে এক আবেশ জড়িয়ে নিত। এখানে তখন শান্তিদেব ঘোষ, সাবিত্রিদেবী, মোহরদি, বাচ্চুদি গাইতেন। ওই গানটা শুনেছিলাম বাচ্চুদির গলায়— ‘তুমি কিছু দিয়ে যাও/ মোর প্রাণে গোপনে গো—/ ফুলের গন্ধে বাঁশির গানে,/ মর্মরমুখরিত পবনে।’’’

স্মৃতির যতি বুঝি সুর!

দূরে কোথায় খাম্বাজের সুর ছড়িয়ে পড়ল দিনুঠাকুরের স্বরলিপি ছাপিয়ে। 

লালাদা জর্জ বিশ্বাসের ছাত্র ছিলেন, বিশ্বাসও করতেন তাই প্রাণে গান যাপনে। তাই স্বরলিপির খাঁচা নয়, তাঁর সুর দূরের হাওয়ায় মিশে যেত! 

পৌষের মিঠে রোদে বসে একবার কথা হচ্ছিল তাঁর পৌষমেলা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। সেই সব কথাই পরে সাত সেলাইয়ে জুড়ে আমার ‘পৌষমেলা : স্মৃতির সফর’ সংকলনে জায়গা করে নিল। ‌

‘‘কেন আর সব মেলার থেকে পৌষমেলা আলাদা বলছেন?’’

‘‘দেখো, জীবনে অনেক মেলাই দেখেছি, শিমুল তুলোর মতন মনে এসে ভিড় করে, যেমন আসামের গোয়ালপাড়া জেলার আলোকঝারি পাহাড়ের সাতবোশেখির মেলা, বাংলা বিহার সীমান্তের হাটগামারিয়ার মেলা হয়ে কখনও বা জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্ট বইমেলা, কিন্তু পৌষমেলা আমার জীবনে একটি মেলা বলে চিরদিনই স্বতন্ত্র হয়ে থাকবে।’’

‘‘প্রথমবার মেলায় শান্তিনিকেতন এলেন— সেটা কবে?’’ 

‘‘প্রথম কবে গিয়েছিলাম তা এখন আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। সম্ভবত চল্লিশের দশকের শেষের দিকে। তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তার পরই যাই ১৯৫২-তে। তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। মনে আছে পৌষ উৎসবের সময় গিয়েছিলাম। আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে। থাকার জায়গা ছিল না। বাবার এক বন্ধুর শ্যালক ছিলেন কলাভবনের শিক্ষক, তাঁর নীচু বাংলার বাড়ির বাইরের ঘরে, মেঝেতে, খড় পেতে আমরা শুয়েছিলাম। শান্তিনিকেতনে যে কী শীত তা যাঁরা অভিজ্ঞতায় না জেনেছেন তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না। খুবই কষ্টের রাত কাটানোর পরে, শীতের কষ্ট ভুলতাম মেলায়। সুন্দরী মেয়েদের দেখে।’’

‘‘সুন্দরীদের দেখে...!’’

‘‘তোমাদের দেখা এখনকার সুন্দরী নয়— সে ঠিক রূপকথার মতো! পৌষের মেলাপ্রাঙ্গণের তাদের রুপ ছিন্ন মেঘের মতো। রাতের বেলা নারী পুরুষের পায়ে পায়ে ওড়া ধুলো নতুন আসা বাল্বের নীলাভ আলোয় স্বপ্নময় হয়ে উঠত। তারই মধ্যে কাতারে কাতারে উড়ে যেত শান্তিনিকেতনি মেয়েরা। তাদের ব্রীড়াভঙ্গিতে আমরা মুগ্ধ, আচ্ছন্ন। মুগ্ধ করে দেওয়া মেয়েদের কলহাস্যমুখরতা। উষ্ণতার খোঁজে সেই মেলা প্রদক্ষিণ আজও মনে পড়ে।’’ 

লালাদা স্মৃতি থেকে গল্প বলতেন শব্দে শব্দে ছবি এঁকে। সেই সব ছবিতে নানা রং। নিপুণ ডিটেল। চরিত্রের ভিড়!

‘‘মেলায় সেবার একদিন আমাদের বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সে আজ তিন যুগেরও বেশি কানাডাতে অধিষ্ঠিত, সগর্বে ঘোষণা করল যে, আজ রাতে খাবারটা ‘লীলু দিদা’র বাড়িতে ম্যানেজ করেছি। আমার গরম কাপড় জামা তেমন কিছু ছিল না তাই, হীরের বোতাম ওয়ালা পঞ্জাবি পড়া বন্ধুর কাছ থেকে তার পিতৃদেবের একটি পরিত্যক্ত ফ্লানেলের পঞ্জাবি জোগাড় করে, সেটি পড়েই শান্তিনিকেতনে পৌষের ঠান্ডার সঙ্গে লড়তাম। সেই রাতে মনে আছে আমরা ভুবনডাঙার মাঠ পেরিয়ে অনেকখানি প্রান্তর পেরিয়ে লীলাদির আলো ঝলমলে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। তারই মধ্যে মেলায় গীতাদির সঙ্গে দেখা।’’

‘‘গীতাদি?’’ 

‘‘গীতাদি মানে গীতা ঘটক। তখনও অবশ্য ঘটক হননি, গাঙ্গুলী ছিলেন। হলুদ শাড়ি পরা খোঁপায় সাদা ফুল গোঁজা সুকণ্ঠী গীতাদিকে আজও মনে পড়ে। সেই শীতের রাতে একটি মেয়েকে মেলার মাঠে দেখেছিলাম, তার নাম ছিল জয়িতা। জীবনে প্রথম কোনও নারীকে নিয়ে কবিতা তাকে নিয়েই। কবিতাটির নাম তখন দিয়েছিলাম ‘শান্তিনিকেতনের ছবি’, ‘দেশ’ পত্রিকা নাম কেটে করে দেয় ‘ছবি’। কবিতাটি ছিল এরকম— ‘বারবার আঁকলাম/ মুছলাম তার চেয়েও বেশী/ চোখ চিবুক হুবহু আছে/ ভাবনাটুকু কবে চুরি হয়ে গেছে।’ পৌষমেলাতেই সৌভাগ্য হয় ওয়াঝালকার সাহেবের গান শোনার। তখন বাচ্চুদি-মোহরদি ঢের কম বয়েস। তাঁদের গানে এ কান এখনও পবিত্র হয়ে আছে, তাই অন্য গান শুনতে মন চায় না। 

তখনকার শান্তিনিকেতনে প্রতিটি গাছের গন্ধ, মাটির গন্ধ আলাদা করে চেনা যেত। মেলার সেই মিশ্র গন্ধ আজও মনকে মেদুর করে দেয়। আজ শান্তিনিকেতন অনেক বদলে গেছে, আমারও যাবার সময় হয়ে গেছে, তবু যা রয়ে যায়, যা চিরদিন থাকে তার নামই তো স্মৃতি।’’

কথায় কথায় বেলা গড়িয়েছে। 

শান্তিনিকেতন নিয়ে অফুরান গল্পের রেশ লাঞ্চ টেবিলে— ‘‘আমি বসন্তোৎসব দেখতে আসি, তখন আমি ছাত্র। আর শেষ এসেছি প্রায় একযুগ আগে। তখন হয়তো এত জনপ্রিয় হইনি আমি। ইচ্ছেমতো চারদিকে হাঁটাচলা করে বেড়াতাম। একবার মায়া সেনের সঙ্গে আলাপ হল ঘন্টাঘরের কাছে। মনে আছে, শ্রীসদনের সামনে মেয়েরা আমাকে ধরে গেটের পাশে বসিয়ে পাগলের মতো রঙ মাখিয়ে ছিল। দেখলাম পাশে সুভাষ চক্রবর্তী হেঁটে যাচ্ছে রমলা চক্রবর্তীর সঙ্গে। তখন আমার শরীরও ভাল ছিল। পরে পরে কোনও অনুষ্ঠানে আমার খুব একটা যাওয়া হয়ে ওঠে না। বিশ্বভারতীর অতিথি হয়ে এসেছি কয়েকবার। গান গাইতে এসেছি নাট্যঘরে, সঙ্গে ছিলেন দিলীপ মুখোপাধ্যায়। ঋতু এসেছিল পরেরদিন গান শুনতে। অনুষ্ঠানের পরে আমরা দু’জন পূর্বপল্লি গেস্টহাউসেই খেলাম।’’

‘‘তখনও তো ‘রবিবার’ হয়নি।’’ 

‘‘তখন এ বাড়ি ছিল না, বিভিন্ন জায়গায় উঠতাম। পরে বাড়ি করলাম। দোলে অনেকেই এসেছে আমাদের এই ‘রবিবার’ বাড়িতে। বাগানে দোলের গান হয়েছে চাঁদের আলোয় বসে— কত গান! ‘ও আমার চাঁদের আলো’— এ গান নিয়েও কত স্মৃতি। আমি সবসময় বৈতালিকে যেতে চাইতাম না। বলতাম আমি গান জানি না। মোহরদি শুনতেন না। হাত ধরে টেনে নিতেন গানের দলে।’’

পৌষমেলার মতোই শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব নিয়ে নানা স্মৃতি ভিড় করে আসত লালাদার কথায়-লেখায়। তাঁর ‘খেলা যখন’ উপন্যাসে লিখেছেন বসন্তোৎসবের কথা— “সেবারে বসন্তোৎসবে আমরা সকলেই শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। খুব মজা হয়েছিল সেবারে। সকলে মিলে বিজুদারে বাড়ি উঠেছিলাম পূর্বপল্লিতে। যখনই শান্তিনিকেতনে যেতাম তখন কোনও উৎসব থাকলে মোহরদি স্নেহপরবশে আমাদের ডেকে ডেকে বৈতালিকে নিতেন। বৈতালিকে গান গাইতে আমার কোনওদিনও ভয় করত না, কারণ আমার সরেস গলা অতজনের গলার মধ্যে চাপা পড়ে যেতই। ওইসব সমাবেশে কিছু কিছু ভাল গলার গায়ক-গায়িকা থাকেই লিড করার জন্যে। তাদের গলায় আলাদা করে শোনা যায়। অন্য সকলের গলা কোপাইয়ের বানের জলের মতো একসঙ্গে খড়কুটো বালি-পাথরে মিশে যায়।...

সেবারে আলো দত্ত নাচলেন, ‘দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা হৃদয় আকাশে’। ভীষণ ভিড় ছিল। আমরা ভিড়ের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মেরে নাচ ও যিনি নাচলেন তাঁকে দেখলাম। প্রীতিদা অত্যন্ত মনোযোগসহকারে নট-নড়ন-চড়ন-নট-কিচ্ছু হয়ে তন্ময় হয়ে নাচ দেখছিলেন। নাচ শেষ হবার পরেই শুনলাম, প্রীতিদার সঙ্গে আলোদির বিয়ে হচ্ছে। মোহরদি ম্যাচ-মেকার।  

মোহরদির স্নেহচ্ছায়ায় থাকলে আমারও কোনওদিন এরকম চাঁদের আলোয় শালফুলের গন্ধে ভরে কোনও মুহূর্তে সদ্গতি হতে পারে মনে করে মোহরদির সঙ্গ ছাড়তাম না।’’ 

স্মৃতির যামিনী পট বুঝি খুলে যাচ্ছে!

আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে ইস্তফা দিয়ে বই নিয়ে মাতব শান্তিনিকেতনে— সেটা পঁচিশে বৈশাখ ১৪২৪। শান্তিনিকেতনের রতনপল্লিতে বইওয়ালা বুক ক্যাফের উদ্বোধনে লালাদা এলেন। আবার তাঁর পুরাতনী গানে মাতোয়ারা রবীন্দ্র-পল্লি। তাঁকে ঘিরে ভিড় উপচে পড়ছে। অনুষ্ঠানের পর ‘রবিবার’-এ বসল নিশিঠেক। তারপর থেকে, যখনই ‘রবিবার’ গিয়েছি, অনিবার্য খবর নিয়েছেন আমার গ্রন্থ-বিপণি এবং প্রকাশনা ব্যবসার। এই পত্রিকার।

একবার একটি পত্রিকার হয়ে তাঁকে ছোটগল্প চাইলাম। 

ফেরালেন না, এক বর্ষণমুখর সন্ধেয় ডেকে নিলেন। জানলার ধারে আরামকেদারায় বসে উনি বলছেন। সামনের বিছানায় বসে, টেবিলে কাগজ রেখে লিখে যাচ্ছি। সাড়ে পাঁচ পাতায় পৌঁছে লেখা থামল। পাহাড়ের উপরে মন্দিরে দেবদর্শনে যেতে যেতে প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার সেই গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। এমন করে লেখা দিতেন ‘এখন শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার কলামের জন্যও। কখনও সামনে বসে বলেছেন। কখনও টেলিফোনে বলে যেতেন। কয়েকটি কিস্তিতে এভাবেই লেখা হল— ‘বনচারির ডায়েরি।’

অসমাপ্ত সেই কলামে ভ্রমণ-কথার মধ্যে লিখছিলেন উপন্যাসের পটভূমি। একবার যেমন লিখলেন— ‘‘মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডু দূর্গের মধ্যে রূপমতী মহালের পাশের নিমারের উপত্যকার। পাহাড় খাড়া নিচে নেমে গিয়ে সেই উপত্যকার সঙ্গে মিশেছে। রূপমতী মহালে দাঁড়িয়ে দেখা যায় দূরে রূপালি ফিতের মতো চকচক করছে নর্মদা নদ। রূপমতী সকালে স্নান সেরে এসে সেই নর্মদাকে প্রণাম করে মন্দিরে পুজো দিয়ে তারপরে রেওয়াজে বসতেন। তিনি অত্যন্ত ভাল গাইয়ে ছিলেন এবং সেই জন্যেই সঙ্গীতপ্রিয় আফগান নবাব বাজবাহাদুর রূপমতীর রূপে গুণে আকৃষ্ট হয়ে তাকে রানী করে মাণ্ডুর দূর্গে নিয়ে আসেন। আমার একটি চটি বই আছে যার নাম ‘মাণ্ডুর রূপমতী’। উৎসাহী পাঠক সেই বইটি পড়লে মাণ্ডু ও রূপমতী সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন। নানা লেখার মধ্যেই তো এভাবেই জীবনের নানা স্মৃতি ঘুরে ফিরে ফিরে আসে। কখনও কোনও উপন্যাসের মধ্যে। কখনও কোনও স্মৃতিলেখার মধ্যে।’’

নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন শান্তিনিকেতনের নাট্যঘরে। উদ্যোক্তাদের অনুরোধে তাঁকে মত করালাম প্রধান অতিথি হয়ে আসার জন্য। নির্ধারিত দিনে নিয়ে এলাম কলকাতা থেকে। সারা পথ কেটে গেল লেখক জীবনের প্রথম পর্বের গল্পে। এল সাগরময় ঘোষ আর সরকার বাড়ির কথা। এবং সত্যজিতের চিঠির কথাও। 

শক্তিগড়ে যোগ দিল গোঁসাই সুমন। 

পথে-পিরিচে এ বার যেন দমকা হাওয়ায় টলোমলো আমাদের এসইউভি!

পরদিন নাট্যঘরে তাঁকে দেখার জন্য মানুষের কি উন্মাদনা। সকলেই তাঁকে একটু ছুঁতে চান। তাঁর কথা কেবল নয়— তাঁর গাওয়া টপ্পাঙ্গের গান শুনতে চান। গেয়েছিলেন লালাদা। ভিড় টইটম্বুর নাট্যঘর নির্বাক হয়ে শুনেছিল— ‘ভালবাসিব বলে ভালবাসিনে’। 

এই গানটির রচয়িতা নিধুবাবু না কি শ্রীধর কথক— এ নিয়ে সংশয় আছে। আসলে নিধুবাবুর পরে তাঁর ধারাকে ধরে রেখেছিলেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্য শ্রীধর কথক। শ্রোতারা তাঁর অনেক গান নিধুবাবুর গান বলে মনে করতেন। তবে নিধুবাবুর গান ছিল আটপৌরে শব্দে গাঁথা। সেই কারণেই তাঁর গানকে ঘিরে অশালীনতার অভিযোগ উঠেছিল। সেই সব আখড়াই গানের কথা ও সুর শোনার সৌভাগ্যও হয় ‘রবিবার’-এ লালাদার কাছে। 

একবার আলাপ করতে চাইলেন আমার সঙ্গিনীর সঙ্গে। ডিনারের আমন্ত্রণে দু’জনে ‘রবিবার’ যেতেই, কথায় কথায় গানের কথা উঠল। সঙ্গিনী গেয়েছিল— ‘নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে, ধর বন্ধু আমার কেহ নাই।’ তার এই গানের স্মৃতি আমার চিরদিনের। গহন অর্চনার, মনকেমনের গান। একা অথবা সমবেত শুনেও— কখনও পুরনো হয় না। সঙ্গিনীর সুর শুনে লালাদা বলেছিলেন, বাংলা দেশের কোন অঞ্চলের গান সেটি। আমার চিরদিনের ভালবাসার মেয়েটিকে উপহার দিয়েছিলেন, তাঁর ‘প্রাচীন বাংলা গান’-এর সিডি।

আর নিজে শুনিয়েছিলেন, রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর— ‘তোমারি তুলনা তুমি প্রাণ/ এ মহীমন্ডলে,/ তোমারি তুলনা তুমি প্রাণ।/ যেমন আকাশে পূর্ণ শশী/ সে কাঁদে কলঙ্ক-ছলে,/ তোমারি তুলনা তুমি প্রাণ।’

আমাকে একা রেখেই সেই সঙ্গিনী ফিরে গেছে তার মেয়েবেলার শহরে! 

যেদিন খবর এল, লালাদা নেই— একা একা বৃষ্টি ভিজে সন্ধেবেলা ‘রবিবার’-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বন্ধ ফটক। গেটের সামনে কেউ ফুল রেখে গেছে। ভিতরে ঘরে আলো জ্বলছে না আজ। জানি, আর কখনও কেউ চোস্ত হিন্দিতে দরোজা খুলে দিতে হুকুম দেবে না, ‘কম্্লেশ—!’ ভিতরমহল থেকে টপ্পার সুর ভেসে আসবে না— ‘সৌরভে গৌরবে/ কে তব তুলনা হবে?/ আপনি আপন-সম্ভবে/ যেমন গঙ্গাপূজা গঙ্গাজলে।’ 

এই অন্ধকারে, বাড়ি-বাগান-চারপাশ জুড়ে নেমেছে অনন্ত নিভৃতি! 

স্মৃতির খপ্পর বড় নির্দয়!

(লেখাটি শারদীয় এখন শান্তিনিকেতন-এ প্রকাশিত)


Post a Comment

0 Comments