স্মৃতির সখ্য : সোমনাথ হোর



সোমনাথদা

স্বপন কুমার ঘোষ


শিল্পী সোমনাথ হোর-এর সঙ্গে প্রথম আলাপ-পরিচয়ের মুহূর্তটি আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। হিসেবে দিন ঠিক মনে নেই। তবে সালটা আজও স্পষ্ট, ১৯৭২ সালের কথা। দেশের বিশিষ্ট চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব ও প্রবাদপ্রতিম প্রাবন্ধিক চিন্মোহন সেহানবিশ ও তাঁর সহধর্মিনী শিক্ষাব্রতী ও কলকাতার ‘পাঠভবন’ স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উমা সেহানবিশ শান্তিনিকেতনে এসেছেন, সেবারে উঠেছিলেন পূর্বপল্লিতে তাঁদের এক বন্ধুর বাড়িতে। 

আমাকে দেখা করতে যাবার জন্য খবর পাঠালেন। দেখা করতে গেলাম। নানা বিষয়ে কথা হওয়ার পর, চিনুদা ও উমাদি বললেন, “এবারে আমাদের বন্ধু সোমনাথ হোরের সঙ্গে তোমাকে আলাপ করিয়ে দেবো।” আমি মনে একরাশ কৃতজ্ঞতা নিয়ে বললাম, “এ তো আমার কাছে পরম সৌভাগ্যের।”

বোলপুর বাড়ি ফিরবার পথে ভাবছিলাম যে, একালের শিল্পদ্রষ্টা, একজন মানবকেন্দ্রিক শিল্পী আর অনেক বড় মাপের উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ সোমনাথ হোর-এর সঙ্গে চিনুদা ও উমাদির সৌজন্যে আলাপ-পরিচয় হবে — এটা ভাবতে ভাবতেই আমার মন আনন্দে ভরে উঠেছিল।

কখনও হেঁটে, তবে বেশিরভাগ সময় সাইকেলে চেপে মাথায় টোকা, কাঁধে বিচিত্র ধরনের ঝোলা নিয়ে তাঁকে অনেকবার দেখেছি। ভাবতাম যে, সততার প্রাচুর্যে ভরা এই মানুষটি অবিচল আছেন সমাজতন্ত্রের দর্শনে।

চিনুদা-উমাদির সঙ্গে এক সন্ধ্যায় কলাভবনের পাশে সোমনাথদার কোয়ার্টারে গেলাম। এই কোয়ার্টারটি এখন আর নেই। ওঁনারা পরিচয় করিয়ে দিলেন— সোমনাথদা ও রেবাদির সঙ্গে। দেড় ঘন্টার বেশি ছিলাম। নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আমি খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম, মাঝে-মধ্যে আমিও অংশ নিয়েছি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘সপ্তাহ’তে লেখালেখি করি শুনে সোমনাথদা খুশি হয়েছিলেন। 

সেদিনের সেই পরিচয়পর্ব ধীরে ধীরে আমাদের নিবিড় পারিবারিক সম্বন্ধে রূপ নিয়েছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৬-এর সেপ্টেম্বর অবধি — এই দীর্ঘ বছর সোমনাথদা, পরবর্তী সময়ে রেবাদির সঙ্গে আমার প্রায় নিবিড় যোগ ছিল।


দুই

প্রায় ২৪ বছর আগে ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের গোড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে ‘সানন্দা’র সহকারী সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক, চলচ্চিত্র ও শিল্প বিশেষজ্ঞ শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় আমায় বলল, “স্বপনদা, তুমি সোমনাথদার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নাও আমাদের ‘সানন্দা’র পার্বণীর জন্য।” আমি চকিতে বিস্মিত হয়ে বললাম, “আমি!” শুনে বলল, “হ্যাঁ, একমাত্র তুমিই পারবে এ-কাজ সম্পন্ন করতে। তোমার সঙ্গে সোমনাথদার যে সম্পর্ক তাতে উনি তোমাকে ফেরাবেন না।” সেবারে কলকাতা থেকে যখন ফিরে এলাম শান্তিনিকেতন, এইরকম একদিন সোমনাথদা লাইব্রেরির সামনে এসে আমায় ডাকলেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হতে নানা কথার পর মনে কুণ্ঠা নিয়েই বললাম, “সোমনাথদা, ‘সানন্দা’ থেকে শিবাশিস আপনার একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বলেছে ওঁদের পার্বণী সংখ্যার জন্য।” একটু দ্বিধা নিয়েই কথাগুলো যেন বলেছিলাম। উনি বুঝতে পারলেন। বললেন, “এতে এত সংকোচের কী আছে স্বপন! দেখো তোমার আমার যে সম্পর্ক তা তো আন্তরিক এবং পারিবারিক। সুতরাং তোমার এত দ্বিধা বা চিন্তার কিছু নেই। তুমি তোমার রেকর্ডিং মেশিন আর প্রশ্ন নিয়ে বাড়ি চলে এসো।” তাঁর কথায় খুব নিশ্চিন্ত হলাম আমি। তারপর সাক্ষাৎকার নেওয়া হল। সেই ১৯৯৭ সালে প্রায় তিনদিন ধরে চলল সোমনাথদার সাক্ষাৎকার-পর্ব। 


তিন

কেমন মানুষ ছিলেন সোমনাথদা?

নিরন্তর অনুশীলন, শিল্পকে দেশ স্পন্দনের অন্তর্গত করা, দুঃসাহসিক পরীক্ষা প্রবণতায় সমাজমনস্ক দর্শকের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠেন সোমনাথ হোর। আর্ট স্কুলের খণ্ডিত শিক্ষা, বাস্তবকে শিল্পে ব্যবহার, শিল্পমাধ্যমে সামাজিক দায়বোধ প্রকাশে তিনি অনন্য। সোমনাথদা প্রশান্ত অথচ তিনি ছিলেন একজন যথার্থ জীবনশিল্পী।

আধুনিক ভারতীয় চারুকলা ও ভাস্কর্য শিল্পের বিরল ব্যক্তিত্বদের অন্যতম পুরোধা পুরুষ সোমনাথ হোর — এ-বিষয়ে আজ আর কোনও বিতর্ক নেই৷ দায়বদ্ধ শিল্পের চল্লিশ দশকী ঐতিহ্যের অন্যতম তিনি। সংগ্রামী কর্ম ও শিল্পের সমন্বয়ের এমন উদাহরণ দুর্লভ।

শিল্প যদি একেবারে জীবন থেকে না উঠে আসে — তবে তা শৌখিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে জীবনের সঙ্গে তার যোগ ছিন্ন হয়ে যায় অনায়াসেই। সোমনাথ হোর ছিলেন সেই জাতের শিল্পী, যার অনুপম শিল্প সৃষ্টি ও চিন্তা ভাবনা একেবারেই নিপীড়িত জীবন মমত্ব থেকে উঠে এসেছে।

সোমনাথদার জীবন ও শিল্পভাবনা একইসঙ্গে নিবিড়ভাবে পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল, যা কখনওই একটার সঙ্গে অপরটিকে আলাদা করে দেখা যায় না। তাঁর কাজে এবং নিয়ত সৃষ্টির মধ্যে শিল্পীর সামাজিক দায় ও নান্দনিক বোধের এক সার্থক সমন্বয় ঘটেছিল৷

শিল্পসৃষ্টি ও ভাবনা, দায়বোধ এবং বিবেক চর্যার মিশ্রণ তাঁর জীবন থেকে উঠে এসেছিল বলেই বিস্ময়কর শিল্পজ সামর্থে তা হয়ে ওঠে অনন্য ও মৌলিক। একদিন মেহনতি মানব-প্রীতির আদর্শকে গ্রহণ করে এবং তাকে বিশ্বাস করে মনের মধ্যে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। সেই আদর্শের প্রতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিশ্বস্ত ও অটুট থেকেছেন।

প্রথম জীবনে দীক্ষিত কমিউনিস্ট সোমনাথ হোর তাঁর শিল্পসৃস্টির বাস্তব রুক্ষ, জীবনের পটভূমি পার হতে হতে একদিন ‘ক্ষত’-র দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন মনে-প্রাণে৷ তাঁর বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, চারিপাশে অসুস্থ, পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় তিনি দেখেছিলেন জীবনযুদ্ধে আহত মানুষের ক্ষত।

এই ক্ষত’ই ছিল — সোমনাথ হোরের কাছে নিয়ত সংগ্রামের প্রতীক। তাই এই প্রত্যয়ের মূল ধারাটি নানান রূপে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এসেছে। কি ছবিতে, কী জীবনে — এই প্রত্যয়ী ঋজুতাই ছিল সোমনাথ হোরের প্রধান চরিত্র ও উজ্জ্বল দিক।

ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে বিশেষ করে গ্রাফিক শিল্প বা ছাপচিত্রে তাঁর অবদান পরিমাপ করা যায় না। তাঁর প্রত্যক্ষ আগ্রহে ও তত্ত্বাবধানে এই গ্রাফিক শিল্পের মাধ্যমটি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে। এখন ছাপচিত্র শিল্পের দুনিয়ায় খুবই জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত। ছাপাই ছবিতে সাদা-কালো ছাড়াও অন্য রং ব্যবহার করেছেন বেশ যত্নে আর দক্ষতার সঙ্গে।

তেতাল্লিশের মন্বন্তরে আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শিল্পকে যুদ্ধের হাতিয়ার করতে তাঁকে প্রবৃত্ত করেছিল — তবে তা সোচ্চার ছিল না। সেই থেকে সোমনাথ হোর কখনও হ্যান্ডমেড পেপারে, কখনও ছবিতে আবার কখনও বা ভাস্কর্যে চিরায়ত ক্ষত’র যন্ত্রণাকে অবিরাম রূপ দিয়ে গেছেন।

তিনি ছিলেন একদম শিশুর মতোন সরল। তাঁর সততার প্রাচুর্য — আমাদের সকলের কাছে গভীর ঈর্ষার বিষয়৷ তিনি এক বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব, কিছুটা অভিমানীও ছিলেন। কাউকে অতি স্পষ্ট কথা বলতে কখনও একদম ভয় পেতেন না। কোনওরকম ভণিতা ছিল না। কী ছবিতে কী জীবনে — এই প্রত্যয়ী ঋজুতাই সোমনাথ হোর-এর প্রধান চরিত্র ও উজ্জ্বল দিক ছিল৷

তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ আলোচনায় বারবার উঠে আসত কমিউনিস্ট পার্টি, রবীন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী, নন্দলাল, রামকিংকর, কলাভবন, সাহিত্য, শিল্প, পরিবার-পরিজন, দেশ, পৃথিবী প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়। কলাভবনের ‘নন্দন’-এ কখনও কোনও প্রদর্শনী হলে সোমনাথদা সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাতেন আমায়৷ উনি বলতেন, “স্বপন, আজ চারটের সময় মামার ক্যান্টিনে চলে এসো।” তারপর দু’জনে মিলে একসঙ্গে কলাভবনে প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। ঠিক ছাত্রের মতো অনুসরণ করতাম তাঁকে আর উনিও আন্তরিকভাবে আমাকে ছবির বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিতেন।

সপ্তাহে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়দিন সোমনাথদার বাড়ি আমি যেতাম। প্রায়দিনই বিকেল বেলায়৷ আর আমি যখন ঢুকতাম ওঁর বাড়ি তখন প্রায়শই দেখা হত কলাভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ চিত্রশিল্পী দিনকর কৌশিকের সঙ্গে। আজও মনে পড়ে সোমনাথদার বাড়িতে বিভিন্ন স্বাদের আয়োজন — মুড়ি, নাড়ু, চা, খেতে খেতে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ, দীর্ঘতর আড্ডা। তাঁর সঙ্গে দিনে দিনে এত নিবিড় হল সম্পর্ক যে কোনও কিছু হলেই ডাক পড়ত আমার — আনন্দে, দুঃখে। আমি শামিল হতাম তাঁর ডাকে। যে কোনও মুহূর্তে সোমনাথদার কাজে শামিল হওয়া ছিল আমার জাতীয় কর্তব্য। একবার কী হল, তখন উনি থাকতেন লালবাঁধের বাড়িতে, রিকশায় করে লাইব্রেরীর সামনেটায় এসে ডাকলেন আমায়, বললেন, “স্বপন, আমাদের অঞ্চলের টেলিফোনটা সাত-আটদিন ধরে খারাপ। কী করা যায় বলো তো!” আমি বললাম, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি দেখছি কী করা যায়!” 

এরপর কিছু কথাবার্তা হল, তারপর উনি বাড়ি চলে গেলেন। সে-সময় দুবরাজপুরে পার্টির সভায় যোগ দিতে এসেছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি উঠেছিলেন বোলপুর ডাকবাংলো’তে। তাঁর সঙ্গে সোমনাথদার বড় আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সোমনাথদার সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম। তাঁকে বললাম পুরো বিষয়টা। সবটা শুনে উনি বললেন, “ঠিক আছে স্বপন আপনি যান, আমি দেখছি বিষয়টা।” তারপর আমি বাড়ি ফিরলাম আর সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন পার্টির মিটিং-এ। একটু খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম সেরে উঠেছি এমন সময় ওই বিকেল চারটে নাগাদ আমার টেলিফোনটা বেজে উঠল, ফোন ধরতেই ওপারে, — “আমি সোমনাথ বলছি!” 

আমি তখন চমকে গিয়ে বলি, “আপনার ফোন-লাইন এরমধ্যেই ঠিক হয়ে গেছে!” শুনে উনি হেসে বললেন, “সবই তো তোমার জন্য...।” আমি বললাম, “না না সব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্য।” এইভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলাম আমি সোমনাথদা’র সঙ্গে।

Post a Comment

0 Comments