নতুন এক আরম্ভের জন্য : নাটকের কথা


নতুন এক আরম্ভের জন্য

আবীর মুখোপাধ্যায়


কোনও কোনও সিনেমা থাকে, ছবি দেখে হল থেকে বের হয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কোনও বই হয়, শেষ করে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকি। সম্প্রতি বরানগরের রবীন্দ্রভবনে একটি নাটক দেখে এমন মনে হল— কথা বলিনি ঢের রাত অব্দি কারও সঙ্গে। নাটকের ভিতর ঘরের কথা ও উপকথন আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল!

বরানগর রবীন্দ্রভবন কানায় কানায় উপচে পড়া ভিড় নয়, বরং কিছুটা শূন্য অডিটোরিয়ামে দেখা হল ‘আর এক আরম্ভের জন্য’। নিবেদনে : স্রোত নাট্য একাডেমী (বরানগর)। এ লেখার প্রথম পর্বেই সেই কারণে পরিচালক বিমান চক্রবর্তীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি এমন একটি প্রযোজনা উপহার দেওয়ার জন্য। অনন্য তাঁর নাট্য-নিবেদন।

এ নাটকের আর্থিক সহযোগিতা : পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমী , তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর , পশ্চিমবঙ্গ সরকার। রচনা : অশ্রুনু মৈত্র । নির্দেশনা : বিমান চক্রবর্তী। আবহ : মৃগনাভী চট্টোপাধ্যায় ও ইশান সাহা।  আবহ প্রক্ষেপণ : আয়ুশ মজুমদার। আলো: দীপঙ্কর দে। রূপসজ্জা : শেখ ইব্রাহিম। অভিনয়ে : রাজু , লিসা, প্রতাপ মন্ডল, সৌম্যদীপ দে, কিংশুক মুখোপাধ্যায়, সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, স্নিগ্ধা মৈত্র, মৃদুল ভট্টাচার্য্য। সঙ্গে ছিলেন শান্তিনিকতনের দুই বাউল বন্ধু। মঞ্চ : মদন হালদার, মঞ্চ ভাবনা : কমল ব্রহ্ম। বিশেষ সহযোগিতায় : সুভায়ণ হালদার, অভিজিৎ দত্ত।

এ নাটকের কাহিনির মূল সুরটি অন্বেষণ। পরিচালকের কথায় : ‘‘মুক্তি হচ্ছে ব্রহ্ম। আর এই মার্গের পথ হচ্ছে প্রেম। যে প্রেম স্নেহের দ্বারা লালিত। জীবনের উপজাত দ্রব্যের চাহিদার চাপে পিষ্ঠ এক অনন্যা নামাঙ্কিত এক মানুষ খুঁজতে থাকে সেই মুক্তির মার্গ। অগ্রদূত হয়ে দেখা দেয় তার দাদু। যার স্নেহে লালিত এক পুষ্ট মননের শক্তিশেল তৈরি হয় নাতনি অনন্যার অন্তরে। যা ধ্বংস করে দেয় তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের নানান চাহিদা। খুলে যায় সংসারের বাহ্যিক দ্রব্যের থেকে অনেকদূরে হারিয়ে যাওয়ার মুক্তির মার্গ। অনন্যা এই পথ ধরেই শুরু হয় আরেক মুক্তিযুদ্ধ।’’

নাটক শুরু হয় এক প্রজন্মের মুক্তির ইঙ্গিতে— যার শেষ দৃশ্যেও অনন্যাকে দেখা যায় ‘আর এক আরম্ভের জন্য’ নতুন এক দিনের পথে সে রওনা দিচ্ছে মুক্তি জন্য। দাদুর আদর্শ, দাদুর দর্শন, দাদুর মার্গ সে বেছে নেয়। দাদুর অসমাপ্ত কাজ যেন সে কাঁধে তুলে নেয়— প্রতিকায়িত, কিন্তু দর্শকের কাছে শেষ দৃশ্যে অনন্যা দাদুর ঢাল ও তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ যেন সমবেত করে তোলে নাট্যঘরের মন। সময় ও সময়ের অবরুদ্ধ সব কিছুর বেড়া ভেঙে যেন দর্শকের মন মুক্তির আনন্দে নেচে ওঠে অনন্যার সঙ্গে সঙ্গে। 


নাট্য-ব্যক্তিত্ব সলিল সরকার এ নাটকের মহড়া দেখে কয়েকদিন আগেই ‘বন্ধ দরজার আড়াল থেকে’ শীর্ষকে লিখেছিলেন, ‘‘ইদানিংকালে প্রসেনিয়ম মঞ্চে থিয়েটারের নামে নাচনকোদন আর ঢক্কানিনাদ এবং ভাঙা ঘরে নক্ষত্রের ভিড় দেখে সেই কবেকার কবি মধুর বলা কথাই নগ্নসত্য হয়ে ওঠে। কাল যে নাটকের মহড়া দেখলাম তা কিন্তু বিষয় বিন্যাসে অভিনব না হলেও আন্তরিক।

বিশেষ করে পরিচালক বিমান অভিনয় করে চমৎকার। আর কলকাতার মেয়ে বিশ্বভারতীর ছাত্রী লিসা যেমন সপ্রতিভ তেমনি সম্ভবনাময়ী। তার সুমধুর কণ্ঠস্বর ও শরীরী ভঙ্গীমায় বিষয়ের গভীরে পৌঁছনোর আপ্রাণ প্রয়াসী।’’ সলিল আরও লিখছেন— ‘‘নাটকের বিষয়বস্তুর প্রশংসা করব এই কারণে তারা সময় থেকে পালিয়ে বিমূর্ত প্রতারণার বাহবা কুড়োতে চাইছে না। ভুল ত্রুটি নেই একথা বলব না বরং তারা নিজেরাই একটি অজানা মুক্তির সন্ধান করছে নিবিষ্ট মননে এটাই প্রশংসনীয়। নাটকপ্রণেতা অশ্রুনু মৈত্র আমার পরিচিত নয় কিন্তু তার নামের মতোই নাটকটিও আশাজাগানোর ঘুম ভাঙানিয়া যা নাট্যের বুকে চমক দিয়ে দর্শক জাগাবে নিশ্চিত।’’

নাটকে অনন্যা দিল্লি থেকে দাদুর কাছে বেড়াতে আসে, সেখানে দু’একটি দিনে ঘটনা আবর্তিত হয়। তাঁর দাদু সত্তরের দশকের রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। দর্শক দেখে নতুন সময়ের এমএলএ— অনন্যার বাবা-মা কিংবা অনন্যার প্রেমিক— এই চরিত্রগুলিই মূলত অনন্যা, দাদু চরিত্রগুলিকে উজ্জ্বল করে তোলে। কাহিনির প্রতি বাঁকেই এ নাটকের দর্শকের প্রাপ্তি সংলাপ। নিছক শব্দ নির্ভর নয়, দেশ-কালের সার-সত্যটি যেন বারে বারে বলা হয়। আসে রবীন্দ্রনাথের গান, কখনও বাউল সুর। জীবনের মুক্তির আনন্দ তাতে জীবনাননন্দীয় ছন্দে একাকার হয়ে যায়।

এ নাটকে অনন্যার চরিত্রে লিসার অভিনয় দর্শক বহুদিন মনে রাখবে। নাটকের আশিভাগ সময় তাকে মঞ্চে দেখা যায়। কিন্তু কখনও একঘেঁয়ে মনে হয় না তাঁর উপস্থাপনা। কখনও ক্লান্তিকর মনে হয় না তার চরিত্রের নির্মাণ। তার ভিতরের জ্বালা-দহন আমাদের শব্দে বেঁধে রাখে না— কখনও আনমনা— নৈঃশব্দের পাহাড়ে নিয়ে যায়। নাটক দেখতে দেখতে কপালে বিনবিন ঘাম জমে। পাশের চেয়ারের দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে ফেলি! নাটকের নানা-পর্বে অনন্যা চরিত্রের সঙ্গে কথা-বিনিময় তাঁকে ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে দেয়। 

দাদু চরিত্রে পরিচালক স্বয়ং। তিনি যেন এ নাটকের ভিতরমহলের পাহারাদার। তাঁর অভিনয় দক্ষতা প্রতিটি দৃশ্যেই দর্শককে ভাবায়। অনন্যা জন্মদিনে কেক কাটার দৃশ্য কিংবা দাদুর মৃত্যুর আগে কথোপকথন দৃশ্য যেমন, দাদুর গুণ শেখানোর দৃশ্য কিংবা এমএলের সভায় হাজির হয়ে মাইক কেড়ে নেবার দৃশ্যও এ নাটকে মুহূর্ত তৈরি করেছে। ভাল লাগে চিনু চরিত্রটিকে। সমাজের নানা ঘটনাপুঞ্জের মধ্যে এগোতে এগোতে তার সহনশীল মন, অনন্যার সঙ্গে আন্তরিক আলাপ— দর্শকের নজরকাড়ে।

নাটক দেখার সেই রাতে— একটু বেশি রাতে প্রিয় মানুষদের টেক্সট করেছিলাম— এমন একটি নাটক আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছনো দরকার। 

কেন না, এ নাটকের কাহিনি কোনও একটি সময়, বা ব্যাক্তির নয়— এর অভিঘাতটি মালুম হয় বহু জনতার মাঝে। হয়তো সেই ভিড়ে আপনি একা হয়ে পড়বেন! কিন্তু আলাদা করে অন্তরকে জাগাবে। মুক্তির কথা বলবে। মুক্তি— অনন্যা যেমনটি দাদুর সঙ্গে বদ্ধ ঘর থেকে পালিয়ে গগনতলে সহজিয়া যাপন দেখতে দেখতে বলেছিল, ‘‘একটা দিনকে গোটা লাগছে, কী পরিপূর্ণ! এদের মাঝেই আমি যেন আমার দেশকে দেখতে পাই!’’ 



Post a Comment

0 Comments