লকডাউনের দিনলিপি

পোস্টডক কাতর, বেকার দিব্যি আছে

তড়িৎ রায়চৌধুরী


মহামারী মানেই বোধহয় অস্পৃশ্য রোগ। করোনা তো অশরীরী, দেখা যায় না অথচ শ্বাসরোধ করে দেয়। নিঃশব্দে গলা টিপে খুন। কি সাংঘাতিক!
লকডাউনের প্রথমদিকে অনেক ঘুমিয়েছি। এখন ঘুম ফুরিয়ে গেছে। ভাগ্যিস ফ্ল্যাটের পাশেই বৃক্ষে ঘেরা আস্ত পুকুর ছিল। নইলে এ সমৃদ্ধ কলকাতায় মোবাইল ছাড়া চোখ রাখার জায়গা জুটত না।
জীবনস্মৃতি মনে পড়ে, খড়ির গন্ডীতে বসে পুকুরের স্নানদৃশ্য। না এ পুকুরে দুটো পানকৌড়ি ছাড়া কেউ স্নান করে না। আগে একটাই ছিল, ইদানিং দেখছি দুটো। ওরা তো মানুষের মতো বিষিয়ে যায়নি। ওদের কোয়ারান্টাইন নেই। দুটিতে দিব্যি জলকেলি করে। সকালের দিকে সব মাছ উঠে আসে জলের উপরতলে— কত মাছ পুকুরটায়! দু’চার দিন ছিপ ফেলেছিল মেছো-মানুষরা। একদিন পুলিশ এসে চোটপাট করাতে সব হাওয়া। ইস্ লোকগুলোকে দেখে তাও নির্বাক সিনেমা সিনেমা ফিলিং হতো।
আর একটা মাছ শিকারী আসে— মাছরাঙা। কিংফিশার। এতদিন মদ আর মোহিনী ক্যালেন্ডার ছিল, এখন উজ্জ্বল নীল কৃষ্ণের জীব। আহা চোখ ফেরানো যায় না। এখন যে আসে সে ছোটখাটো। আগে ওর মা/ বাবা আসত? তারা কি মারা গেছে? নাকি অন্য জল খুঁজে নিয়েছে?
এই পারিবারিক গন্ধটা বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকল। ইলোরা উঠে পড়েছে। ব্রেকফাস্টের তোড়জোর হবে। পেটে তো আর লকডাউন হয়নি। হ্যাঁ কমে গেছে। সপ্তাহে একদিন বাজার। তাও তো বাজারিরা বলল— ‘দেখি দাদা আর কদ্দিন আসতে পারি।’
‘সে কি গো। খাব কি?’
‘বেশি করে কিনে রাখুন দাদা। চারদিকে যা ঘিরছে।’
তা সত্যি। ঘোষিত লকডাউনের শেষবেলায় ডুবছে কলকাতা। ওদিকে গড়িয়া ব্রিজে নাকা চেকিং, রামগড় ক্লোজড, মুদিয়ালিতে থার্মাল টেস্টিং চলছে, হরিদেবপুর সিল্ড। মাঝখানে যেন দ্বীপের মতো ভূখণ্ড— ‘একখানি ছোট খেত আমি একেলা/ চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।’ কোন খেলা যে খেলছো কখন... গানটা কি সুন্দর গাইতো সৌমী। এখন ম্যাসাচুস্টেস-এ কেমিষ্ট্রিতে পোস্টডক। যখন গেল আমাদের কি উল্লাস। এতো ভাল সুযোগ! ফোন করেছিল কাল। ‘কি হবে দাদা; বিদেশ বিভুঁই-এ একা বোকা, কি বিপদেই না পড়লাম।’ ভেজা ভেজা লাগল গলাটা। সত্যিই কাকে বলে ভাল? তীর্থ ফিরে গেছে সুন্দরবনে। সত্যিকারের দ্বীপেই ওর বাড়ি বাগান পুকুর মাঠ। সূর্যাস্তের সামনে বসে মাউথঅরগ্যান বাজিয়ে ভিডিও পাঠিয়েছে— আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
‘না না। আসলে গাঁয়ে তো সবাই চাষাভুষো। বাইরে আর কে যায়! কেটে যাচ্ছে দাদা।’
কেটে যাচ্ছে ভোরের ভৈরবী। কিচ্ মিচ্ ঢেকে যাচ্ছে কা কা শব্দে। দু’চার জন করে বাজাড়ু চলেছে পুকুরের ওই পাড় দিয়ে। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, গোটা শরীর ঢেকে যেন মহাকাশযাত্রী। রোজ রোজ কেউ মঙ্গলে জল খুঁজতে যায়? উনি যান টাটকা ছোটো মাছ কিনতে। ‘সারা বছর তো অফিসের ক্যান্টিন আর রবিবারের বাজারের উপর ভরসা। পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো যে সময়টা পেয়েছি কাজে লাগবো না? রোজ সকালে ফ্রেশ সব্জি মাছ খেলে ইমিউনিটি পাওয়ার এমনিই এতো বেড়ে যাবে, করোনা কিছু করতে পারবে না। ইউরোপ আমেরিকায় এতো মরছে কেন বলুন দেখি— ব্যাটারা সব ফ্রিজিড ফুড খেয়েই মলো।’ সেলসে কাজ করেন ভদ্রলোক। এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কোম্পানি থেকেই ল্যাপটপ আর ডঙ্গল ঘরে ভরে দিয়েছে। আমাদেরও স্কুল বলেছে অনলাইন ক্লাস। তবে ব্যবস্থাপাতি আপনা আপনা। আসলে বাঁচলে তবে তো পড়াশোনা। সবাই জানে পড়াশোনাটা অত্যাবশ্যকীয় নয়। তবে সেটা কি? বিলাসিতা? হয়তো তাই। আমেরিকার পোস্টডক মৃত্যু ভয়ে কাতর। গাঁয়ের বেকার বলছে দিব্যি আছি।
সভ্যতার মাপগুলোই কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। আজ সকালে কি আর ইতিকথাকে পড়াতে বসাবো? কেন বসাবো? ‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা’— শুধু এই জন্য?

Post a Comment

1 Comments

  1. তোর এই চমৎকার লেখাটা একটা অন্য ঠিকানায় পড়তে হল।এমনকি তুইও চেনা ঠিকানার স্থানাঙ্কে নেই।লেখা না বলে চিত্রনাট্য বললেও ক্ষতি নেই।একটা লং শট, আনকাট।এবার কৃট হলে বুঝব ইলোরার জলখাবারে কদ্দূর আর ইতিকথা বইখাতা নিয়ে আদৌ পড়তে বসল কিনা।

    ReplyDelete