ছোটগল্প : পলাশ ও পাখি


পলাশ ও পাখি

শুভায়ন বসু

খড়্গপুরের কাছেই নারায়ণগড় থানার যমুনা গ্রাম। তারই পোস্ট অফিসে বদলি হলুম পোস্টমাস্টার হিসেবে। তখন আমার ঝাড়া হাত-পা, বিয়ে থা হয়নি। প্রত্যন্ত, অখ্যাত, অজানা সব গ্রামে পোস্টিং নিতে তাই বেশ ভালই লাগত। জায়গাটাও চেনা হত। শহুরে ছেলের গ্রামের প্রতি টান তো থাকবেই, চাকরিটা যেন সেই ভালবাসাকেই ঝালিয়ে নেবার একটা সুযোগ এনে দিল।

যাইহোক, দায়িত্ব বুঝে নিয়ে, নিজের কোয়ার্টারখানা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেললুম। জিনিস তো মাত্র কটা বই আর বিছানাপত্র। নিঝুম পাড়াগাঁ, লোকজন কমই আসে পোস্ট অফিসে। স্টাফ বলতে বয়স্ক পিয়ন বামাপদবাবু। বেশ রসিক মানুষ, নানা গল্পে দুজনের বেশ সময় কেটে যায়। বিকেলে নারায়ণগড় থেকে ডাকের গাড়ি এলে, সব চিঠিপত্র বুঝিয়ে, পোস্ট অফিস বন্ধ করে, তবে বাড়ি আসি।বামাপদবাবুও  সাইকেল নিয়ে ফিরে যান বারো মাইল উজিয়ে নিজের বাড়িতে।

এইভাবেই চলছিল বেশ। তবে আস্তে আস্তে বুঝতে পারলুম, গ্রামটার বেশিরভাগ লোকই গরিব আর তারা আটকা পড়ে আছে জাতপাতের নোংরা পাঁকে। ব্রাহ্মণরা তথাকথিত নিচু জাতের লোধা- শবর -হরিজনদের  ছোঁয়াছুঁয়ি এড়িয়ে চলে, থাকেও সব আলাদা আলাদা পাড়ায় । অদৃশ্য একটা লাইন টানা রয়েছে সবখানে, গন্ডি পেরোবার জো নেই।  গ্রামে কারও বিয়েতে সব জাতের লোককে নেমন্তন্ন করা হলেও, ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের জন্য আলাদা বসার জায়গা নির্দিষ্ট করা থাকে। সেখানে নিচু জাতের  লোকদের বসার অধিকার নেই। এমনকি পুজোতে পর্যন্ত এই নিচু জাতের লোকগুলোর কোন স্থান নেই , ছোঁয়া হলেই সব ফেলা যাবে, এমনই ভয়ঙ্কর ঘৃণার  পরিবেশ। লোধা-হরিজনদের বাচ্চারা খেলতে পারে না উঁচু জাতের বাচ্চাদের সাথে, তারা থাকে একধারে। সে ঘরের বউদের পুজোয় ফল কাটাতেও নিষেধ, বলা হয় তাতে নাকি দেবী 'কুপিত' হবেন, সব অপবিত্র হয়ে যাবে। এরকম জাতের নামে একতরফা ঘৃণা, পাল্টা ঘৃণার ভয়ঙ্কর বাড়বাড়ন্ত দেখে বেশ অবাক লাগল, কোথায় পড়ে আছে এরা!

এসব ছাড়া, মোটের ওপর কিন্তু গ্রামটা খুবই সুন্দর। ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়ি এদিক-ওদিক। সবাই খুব খাতির করে, পোস্টমাস্টার বলে কথা। জানিনা সে সময় কোথায় লুকিয়ে থাকে ওদের জাতপাতের বিরোধ আর ঘৃণার দাঁতনখগুলো। আমি নিজে ওসব কিছু মানিনা, তাই নিশ্চিন্তে মিশে যাই সবার সঙ্গে। তবে বেশ বুঝতে পারি, কিছু সতর্ক চোখ সব দিকে নজর রাখছে, বেচাল হবার জো নেই । দেখলুম, গরিব নীচু জাতের মানুষগুলো মুখ বুঁজে সহ্য করে যায় এই অন্যায় শ্রেণীবৈষম্য। ওরা যে অচ্ছুত, আবজ্ঞার পাত্র, তা যেন ওরা মোটামুটি মেনেই নিয়েছে।  আমি সব জেনে বুঝেও কিছু বলতে পারতুম না, আর কাকেই বা বলব! পুরোনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে ধরা এই মানুষগুলোর মন থেকে, এসব সামাজিক বিধি নিষেধ সরিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন কাজ । মাসে একবার অফ ডের সঙ্গে আরও একটা কি দুটো ছুটি জুড়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতুম। এই করেই বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।

একদিন পোস্ট অফিসে বসে মন দিয়ে কটা মানিঅর্ডারে সই করে স্ট্যাম্প মারছি, বিকেলের ডাকে যাবে, হঠাৎ দেখি একটা রোগামত আদিবাসী বউ এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । 'কি চাই?' বলতে সে কোন উত্তর দিল না ।বামাপদবাবু দেখতে পেয়ে, নিজের সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে বউটাকে কি সব বুঝিয়ে দিতে, সে মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। মনে হল , যাবার সময় আঁচলের খুঁটে  চোখ দুটো একবার যেন মুছেও নিল। বামাপদবাবু ফিরে আসতে জিজ্ঞেস করলুম ,'কে উনি?আপনার কেউ হন?' উনি বললেন, 'না না ,ও তো বুদি পাতর। পাখির মা।' আমি অবাক হয়ে বললুম 'পাখি? কোন পাখি ?' উনি মৃদু হেসে বললেন ,'পাখি ওর মেয়ের নাম। ওরই ক্লেমের ব্যাপারে এসেছিল। মেয়েটা মারা গেছে কয়েক মাস হল।' 'কিভাবে?' আমার কৌতুহল দেখে, উনি সেই কাহিনী বলতে শুরু করলেন। বাইরে কড়া রোদ, পোস্ট অফিসে লোকজনও কেউ নেই। পাখির গল্পই শুনছিলুম আমি ।

‘পাখি ছিল গরিব হরিজন। ছোট থেকেই থাকত ওর পিসির বাড়ি। যুবতী মেয়ে, পড়াশোনাও করেছিল। আর সেজন্যই বোধহয় গ্রামের অলিখিত নিষ্ঠুর জাতপাতের নিয়ম কানুন ও মেনে নিতে পারেনি, ভালোবেসে ফেলেছিল ব্রাহ্মণ যুবক পলাশকে।  পলাশও ভীষণ ভালবাসত পাখিকে। ওদের প্রেম ছিল বেশ কয়েক বছরের পুরোনো । কিন্তু একদিন দুজনের বাড়ি থেকেই কিভাবে যেন জেনে গেল ওদের ব্যাপারটা। ব্যাস, আর যায় কোথায় ? উঁচু জাতের লোকগুলো যাদের ঘৃনার চোখে দেখে, মানুষ বলেই মনে করে না, সেই ঘরে প্রেম! ওদের এই সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিল না গ্রামের ক্ষমতাশালী মোড়লরা। ব্যাপক অশান্তি শুরু হয়ে গেল পলাশের বাড়িতে। হাড়ির মেয়ের সঙ্গে ব্রাহ্মনের ছেলের প্রেম কেউ মেনে নিল না। বউ করে আনলে দেবত্ব সম্পত্তি অপবিত্র হয়ে যাবে না? তাছাড়া ঘরে মা কালী রয়েছেন, অজাতের ছোঁয়ায়, ঠাকুরই তো চলে যাবেন। প্রবল ঘৃণার বশে, ওদের ওপর চলল নানা রকম অত্যাচার, নির্যাতন। পাখির পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হল । ওদিকে পলাশ ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে প্রকৃতির ছেলে, খড়গপুরে একটা হোটেলে কাজ করে, ও এসব নিয়ম মানে না। কিন্তু ওর কোন কথাই কেউ শুনল না, জুটল দারুন অপমান, মারধোর পর্যন্ত। ক'দিন এরকম চলার পর, শেষে একদিন ওরা দুজনে মিলে  একটা ভিডিও হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। তারপর থেকেই আর ওদের কেউ দেখেনি।' বামাপদবাবু থামলেন। বোতল থেকে একটু জল খেয়ে, মুখটা মুছে, একটু দম নিলেন। আমার কৌতুহল তখন তুঙ্গে, 'তারপর?' আমি না বলে আর থাকতে পারলুম না। ‘তারপর আর কি? সিনেমা দেখে, দুজনে গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চলে গেল বাখরাবাদের দিকে। রেল লাইনের ধারে সেখানেই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করল ট্রেনের জন্য। রাতের দিকে ভুবনেশ্বরগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সামনে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজনেই শেষ, এক সঙ্গে।  পরে যখন ওদের ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া গেল, পাখির কপালে কেউ কেউ নাকি সিঁদুরের ফোঁটা দেখেছিল।'

'সে কি? সুইসাইড করে ফেলল!',মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ওদের এই নিদারুণ পরিণতি শুনে। মুখটা নামিয়ে নিলুম কি এক লজ্জায়। ওদিকে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু একটুও খেতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। জাতপাতের নিষ্ঠুর পরিণামের কথা ভেবে বুকের ভেতর থেকে একটা ভীষন কষ্ট উঠে আসছিল।

বামাপদবাবু বলে চললেন, 'এখানেই শেষ নয়, বুঝলেন? লাশ কাটা ঘরে পাশাপাশি শুয়ে ছিল পলাশ আর পাখি। ওদের পরিবারের কাছেও ওরা হয়ে গিয়েছিল 'বেওয়ারিশ' প্রেমিক যুগল। জাত ধর্ম ভুলে ভালবাসার অপরাধে, সাত দিনেও কেউ নিতে আসেনি ওদের নিথর দেহ দুটো। নিজেদের সন্তানের দেহ পর্যন্ত নিতে এল না! মরে যাবার পরেও এত রাগ !' বামাপদবাবু ঘটনার কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন।

'এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ!' আমি না বলে পারলুম না । 'বুঝলেন, গোটা গ্রামে কারও কোন হেলদোল ছিল না। উঁচু জাতের ছেলে নীচু জাতের মেয়েকে ছুঁয়েছে, মরেছে, বেশ হয়েছে। তখনও নাক সিঁটকোচ্ছে মানুষ। দুজনের শোকাতুরা মায়েরা যদি দেহ দেখে আরো শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন, তাই বডি গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হল না। বেঁচে থাকতে শাস্তি তো দিতে পারেনি , তাই মরার পর 'বেওয়ারিশ' করে সেই রাগই পুষিয়ে নেওয়া আর কি।পলাশের দাদা শুধু একবার রেললাইনে গিয়ে দেহ সনাক্ত করেই চলে এসেছিল। আর কেউ কোন খোঁজখবর নেয়নি। ময়নাতদন্ত হল, তারপর রেল পুলিশের হেফাজত থেকে দেহ নিতেও আর কেউ গেল না। টাকার অভাবে পাখির মৃতদেহও গ্রামে আনা যাবে না, বলে দিল ওর আত্মীয়রাও। সৎকার করতে দেড় হাজার টাকাই ওদের কাছে অনেক ,গরিব পরিবার তো।' 'দেহ সৎকারও করল না?' আমার অবাক প্রশ্ন। 'না', ক্ষীণ স্বরে বললেন বামাপদ বাবু। 'পুলিশের অনুরোধেও মৃতদেহ নিল না কেউ। শেষকালে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বেওয়ারিশ লাশ দুটো, সাত দিন পরে অন্য সব ওইরকম লাশের সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হল।' থেমে থেমে বললেন বামাপদবাবু। 'এখনও আমরা কত পিছিয়ে আছি, না? ভালোবাসার এরকম শাস্তি!', উনি যোগ করলেন। আমি কিছু বলতে না পেরে, স্তব্ধ হয়ে রইলুম। 

ততক্ষণে বাইরে রোদ পড়ে এসেছে, পোস্ট অফিস বন্ধেরও প্রায় সময় হয়ে গেছে। জানালার বাইরে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হল, অনেক দূরে কোন এক ফুলে ফুলে ভরা লাল পলাশ গাছে বসে, কোন এক চঞ্চল পাখি হয়ত  ঠিক এখনই আপনমনে শিস দিয়ে চলেছে। আমি  দেখতে পাচ্ছি না কেন? 

Post a Comment

1 Comments

  1. পলাশ ও পাখি ভালো লাগলো।

    ReplyDelete